আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

তাঁরা আমাদের পথ দেখিয়েছেন


এক.
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরের এই দিনে হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন দেশের অগ্রণী কিছু মানুষ। আর এক দিন পরই ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ৯ মাসের স্বাধীনতাসংগ্রামে লক্ষ–কোটি নারী–পুরুষের আত্মত্যাগ আর সমগ্র দেশবাসীর অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তাই ৪৯ বছর আগের এ দিনটি আমাদের কাছে একাধারে অনেক দুঃখ আর বেদনার এবং অনেক আনন্দ ও বিজয়েরও।

এই ১৪ এবং ১৬ ডিসেম্বর এলেই আমাদের স্মৃতিতে ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে ভেসে ওঠে বিশেষ কিছু নাম, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী, তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ, আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের অনেককেই ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁরা হলেন লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য, আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, রাশীদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, আবুল কালাম আজাদ, এ এন এম ফয়জুল মাহী, সিরাজুল হক খান, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ, পিপিআইয়ের ব্যুরোপ্রধান সৈয়দ নিজামুল হক, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, ফজলে রাব্বী, মোহাম্মদ মোর্তজা, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভিনসহ আরও অনেকে। স্বাধীনতার উষালগ্নে বাংলাদেশের সেরা অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও আরও অনেককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার–আলবদর বাহিনীর সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

যদিও আমরা ১৪ ডিসেম্বরই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, শুধু সেদিনই যে বুদ্ধিজীবীদের বাসাবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, তা নয়। দেশের সেরা এই মানুষগুলোকে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ঢাকা শহরে কারফিউ চলাকালে দিনরাতের বিভিন্ন সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবেই এই বুদ্ধিজীবীদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল।

তবে বাংলাদেশের লেখক-সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীদের ওপর এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ যে শুধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়েই হয়েছিল, তা নয়। আসলে ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিরোধ লড়াইয়ে শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল বাঙালি পুলিশ, বিডিআর (তৎকালীন ইপিআর) এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতৃত্ব এবং বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ সারা দেশের লেখক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার এক নীলনকশা বাস্তবায়নে তৎপর ছিল তারা। সে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ট্যাংক–কামান–মেশিনগানসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল। তারা ছাত্রদের প্রায় সব হলের ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যার পাশাপাশি শিক্ষক–অধ্যাপকদের বাসায় বাসায় গিয়ে হত্যা করেছিল।

সেই ২৫ মার্চের রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা শিক্ষকদের কোয়ার্টারগুলোতে ভয়ংকর আক্রমণ করে যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, এ এন এম মুনিরুজ্জামান, মুহম্মদ আবদুল মুকতাদির, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, আতাউর রহমান খান খাদিমসহ আরও অনেকে।

দুই.
আমাদের মনে পড়ে, ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে ঢাকা শহরজুড়ে শুরু হয়েছিল অবিশ্বাস্য রক্ত, ধ্বংস এবং মৃত্যুর ভয়ংকর এক অধ্যায়। ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গিয়েছিল। সেই সকালেই আগুনে জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে দেওয়া প্রিয় দৈনিক সংবাদ অফিস দেখে কান্না পেয়েছিল আমার। ঠিক তার আগেই বংশাল থানায় দেখেছিলাম ১০–১২ জন পুলিশ সদস্যের মৃতদেহ। গুলিতে নিহত দু–তিনজনের হাঁ করে থাকা মুখ বা বিধ্বস্ত চোখের কথা এখনো মনে পড়ে।

তারপর সকাল সকাল বংশালের বাসা থেকে বের হয়ে নাজিরাবাজার আর নিমতলী পেরিয়ে মেডিকেল কলেজ–হাসপাতাল ছাড়িয়ে বিধ্বস্ত শহীদ মিনার দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ইকবাল হলে গিয়ে ক্যানটিনের সামনে সারিবদ্ধভাবে ১০–১২ জন শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীর মৃতদেহ দেখে যন্ত্রণাহত হয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল মুকতাদিরের মৃতদেহ। সেদিনের সেই দুঃখ–বেদনার স্মৃতি কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

ইকবাল হল থেকে হেঁটে সলিমুল্লাহ হলের বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে শূন্য কক্ষগুলো দেখতে দেখতে ভেতরে হঠাৎ নজরে পড়ল একতলার ১৩৭ নম্বর কক্ষের মাটিতে পড়ে আছে একটি চশমা। সেটা ছিল আমাদেরই এক ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতা লুৎফুল আজিমের। তবে তাঁর মৃতদেহ কক্ষে ছিল না। এ সময়ে কষ্ট আর কান্না চেপে ধরে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট দর্শনের অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাসভবনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছিলাম। সেই রাতেই সবার প্রিয় সেই অধ্যাপককে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। এবং সেখান থেকে আমাদের প্রিয় মধুদার বাড়িতে মৃত্যু আর বীভৎসতা দেখেছিলাম। পরে সেই হলের আমাদের প্রিয় বন্ধু কালীরঞ্জন শীলের অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যাওয়ার কাহিনি পড়ে আরও বেশি করে জানতে পেরেছিলাম, ২৫ মার্চের রাতে পুরো জগন্নাথ হল এবং হলের মাঠজুড়ে কী ভয়ংকর মৃত্যুর এক রাজত্ব তৈরি করেছিল পাকিস্তানের সেনারা। জগন্নাথ হলের মূল গেটের উল্টো দিকের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বাসভবনের ঘরের ভেতর থেকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে দূরপাল্লার ক্যামেরায় ড. নূরুল্লাহর ভিডিও করা সেই ধ্বংসযজ্ঞের ছবি দেখেছিলাম। সেই সব দিনের ভয়াবহ স্মৃতি কোনো দিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

সেই ২৭ মার্চের দুপুরে এক হল থেকে আরেক হলে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা–কর্মীর কাছ থেকে শুনতে পেয়েছিলাম গোবিন্দচন্দ্র দেব ছাড়াও গুরুতরভাবে আহত জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতার কথা। পাঁচ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ওই ভবনেই থাকতেন সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক এ এন এম মুনিরুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও এমএতে আমাদের শিক্ষক ছিলেন। ধার্মিক মানুষ ছিলেন তিনি। এই অধ্যাপক কখনো কোনো ধরনের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে আমরা শুনিনি। আর দৈনিক সংবাদ–এর অফিসের ভেতরে আগুনে পুড়ে মারা যান শহীদ সাবের। ওই মার্চ মাসেই কবি মেহেরুন্নেসা ঘাতকদের হাতে নিহত হন।

তিন.
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সেসব দিনগুলো–রাতগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়‌ে যায়, স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরুর প্রায় ৯ মাস পর সেই ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমাদের গেরিলা বাহিনী ও অন্য সহকর্মীরা ঢাকার গোপীবাগে এসে পৌঁছেছিলাম। সেদিন সকালে ঘোড়াশাল থেকে নদীপথে পলাশ হয়ে ডেমরার নদীঘাটে যখন পৌঁছেছি, তখন বিকেল হয়ে গেছে, প্রায় চারটা বাজে। আমরা দেখলাম বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে আর হাতে অস্ত্র নিয়ে দ্রুত ঢাকা শহরের দিকে যাচ্ছেন, তাঁদের চোখেমুখে বিজয়ের আনন্দ। আর ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরাও দ্রুত ঢাকার দিকে যাচ্ছেন গাড়ি আর ট্রাকে করে। তবে এর আগেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম যে সেদিনই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমপর্ণ করছে। সেই বিজয়ের সংবাদে তখন আমাদের যাত্রাপথে নদীর দুই পাশের মানুষের মধ্যে প্রবল উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা দেখেছিলাম। আর ছিল চারদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।

মনে পড়‌ে, আমরা দলবল নিয়ে ডেমরা থেকে হেঁটে হেঁটে যখন ঢাকার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন এক অজানা অনিশ্চয়তা আর ভয় কাজ করছিল মনের গভীরে। আমরা তো কিছু জানি না, সামনে কী আছে, কখন পৌঁছাব ঢাকায়। আমরা যখন গোপীবাগে পৌঁছেছি, তখন রাত হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে উঠলাম আমাদের নেতা সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের বাসায় এবং সেখানেই রাত কাটালাম। ততক্ষণে আমরা অনেক কিছু জেনে গেছি। ঢাকা ও দেশজুড়ে মৃত্যু, ধ্বংস, প্রতিরোধ লড়াই এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা।

তারপরের দিন ১৭ ডিসেম্বর সকাল। আনন্দ-বেদনা-উত্তেজনায় গোপীবাগ থেকে বংশালে নিজেদের বাসায় চলে এলাম। এইটুকু পথ রিকশায় যেতে যেতে টিকাটুলী থেকে টিপু সুলতান রোড হয়ে নবাবপুর রোড পেরিয়ে বংশালে পৌঁছাতে রাস্তায় দেখলাম বেশ কয়েকটি মৃতদেহ। নানা জায়গায় আগুন বা ধ্বংসের চিহ্ন। রাস্তায় মানুষের চলাচল প্রায় নেই। তখনো সেই ভয়ের পরিবেশ। দীর্ঘ ৯ মাস পর মা–বাবা আর ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হলো। এত দিন পর দেখা হলেও কেন জানি তেমন আনন্দ–উচ্ছ্বাস ছিল না তাঁদের চোখেমুখে। হয়তো ৯ মাসের দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কা থেকে তখনো বের হয়ে আসতে পারেননি। সাত–আট মাস নানাবাড়ি কাপাসিয়ার গ্রামে গ্রামে জানা–অজানা বিভিন্ন বাড়িতে মা, ভাইবোনেরা ছিলেন ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে। শেষ প্রায় দুই মাসও তাঁরা ছিলেন ঢাকায় আমাদের বংশালের বাসায়। সেদিন সকালে আমি বাসায় বেশিক্ষণ থাকিনি। দ্রুত চলে গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনে। সেখানে স্থাপিত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প।

সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনে পৌঁছে চারদিকে সমবেত মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ছাত্র-কর্মী অনেককেই মনে হলো গভীরভাবে বিষণ্ন। এখনো মনে পড়ে, সেদিন সকালে আমাদের খুবই প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহেদুর রহিমও তাঁর হোন্ডা চালিয়ে চলে এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে। এত দিন পর আবার দেখা, সবাই বেঁচে আছি। তিনি বললেন কী এক ভয়ংকর সময়ে কীভাবে বেঁচে ছিলেন তাঁরা। তখনই আমরা জানতে পারলাম, ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত একে একে দেশের সেরা অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞের ভয়ংকর সব কাহিনি। তখনো সব জানা না গেলেও জানতে পাই যে আমাদের প্রিয় লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার আর নেই। মুনীর চৌধুরীও নেই। সিরাজুদ্দীন হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডা. ফজলে রাব্বী আর ডা. আলীম চৌধুরীরও কোনো খবর নেই। এ সবই ছিল অকল্পনীয়, অসহনীয় এক দুঃসংবাদ। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন আমরা সবাই।

শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ১৯৬৫ থেকে ’৭০-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্যন্ত। তাঁর কাছে কত গিয়েছি, কত ছোট-বড় বিষয়ে সাহায্য নিয়েছি! মুনীর চৌধুরী, ব্যক্তিগতভাবে আত্মীয়তার পরিচয়ের বাইরেও বলব, তিনি আমাদের একজন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী—লেখক, নাট্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী। মুনীর চৌধুরীর বড় ছেলে ভাষণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আগরতলায়। বাবাকে নিয়ে সে যে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের কথা বলেছিল সেদিন, সেসব কথা এখনো মনে পড়ে।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বাংলার শিক্ষক। তাঁকে দেখতাম নানা সেমিনার, আলোচনা সভায়। অতিশয় সজ্জন ও গুণী মানুষ তিনি। ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের সংকলনে তাঁর লেখা আমরা ছেপেছিলাম।

গিয়াসউদ্দীন আহমেদকে নানা সময়ে, নানাভাবে একজন নিপাট ভদ্র ও উদ্যোগী মানুষ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে দেখেছি। সব সময় সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতেন তিনি। অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। নানাভাবে তাঁদের সহায়তা করেছেন।

ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম এ রাশীদুল হাসান ও বাংলার অধ্যাপক আনোয়ার পাশা—১৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বাসা থেকেই দুই বন্ধুকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সে সময়েই আনোয়ার পাশা লিখছিলেন একটি উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত।

সাংবাদিকদের ভেতরে শহীদুল্লা কায়সারের পর যাঁর নাম নিতে হয়, তিনি সিরাজুদ্দীন হোসেন—ইত্তেফাক-এর বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক। ১০ ডিসেম্বর তাঁকে চামেলীবাগের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়, আর খবর পাওয়া যায়নি।

সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬২ সালে, আমি তখন ঢাকা কলেজে পড়ি। তিনি পূর্বদেশ-এ কাজ করতেন। আমরা একসঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, দিনাজপুরের বড় ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর কথা মনে করলেই একজন শান্ত ও ভালো মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। বিবিসির সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ এবং পিপিআইয়ের সাংবাদিক সৈয়দ নিজামুল হককে নানা অনুষ্ঠানে, নানা কাজে দেখেছি।

চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর চেম্বারে ’৬৮-৬৯ সালে দুবার চোখ দেখাতে গিয়েছিলাম। তিনি আজীবন প্রগতিশীল চিন্তাধারার সক্রিয় মানুষ ছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার বড় ভাই গুরুতর অসুস্থ হলে ডা. ফজলে রাব্বী আমাদের বংশালের বাসায় এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মোহাম্মদ মোর্তজাকে জানতাম। তিনি গোপন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই চিকিৎসকেরা চিকিৎসক সংগঠন ও চিকিৎসা ছাড়াও নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা যখন আমাদের দ্বারপ্রান্তে, তখনই ঢাকার বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশ থেকে এ রকম অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে এই শহীদদের কথা লিখতে গিয়ে আরও দুজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। একজন আলতাফ মাহমুদ—সংগীতশিল্পী, সুরকার ও আজীবন সংস্কৃতিকর্মী। তাঁর গান ও সংগীত পরিচালনা প্রায় ষাটের দশকজুড়েই আলোড়ন তুলেছে, এখনো আলোড়িত করে তাঁর গান। তাঁর সঙ্গে সরাসরি পরিচয় ১৯৬৪ সালে ডাকসুর ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে নানা কাজকর্মে সংশ্লিষ্ট থাকার সময়। পরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। পুরো দশকেই তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের কত অনুষ্ঠানে যে তিনি এসেছেন, তার হিসাব নেই। তিনি আজীবন প্রগতিশীল, সংগ্রামী ছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালেও তিনি ব্যাকুল হয়েছিলেন কিছু করতে। তাঁর তৈরি করা বেশ কিছু গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠানো হলেও সীমান্তে ধরা পড়ে যায়। তাঁর বাসস্থলে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মজুত অস্ত্র। সে খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে অত্যাচার করে হত্যা করেছিল।

আরেকজন হলেন লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তাঁর সঙ্গে ষাটের দশকের মধ্যভাগে পরিচয়। আমাদের একুশের সংকলনে লেখা দেওয়া ছাড়াও আমাদের নানান কর্মকাণ্ডে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে। বিজয়ের পর দেশে ফিরে ভাই শহীদুল্লা কায়সারের জন্য একদম ভেঙে পড়েন। ভাইয়ের সন্ধান এবং তাঁকে উদ্ধারের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি ভেবেছিলেন শহীদুল্লা কায়সার মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পে আটক আছেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিহারিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনার সময় তিনি সঙ্গে ছিলেন এবং সে দিনই তিনি শহীদ হন।

এখনো আমার মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর জানুয়ারি মাসের কোনো একদিন পিজি হাসপাতালে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছি, জহির ভাই নিচে নামছেন। মুখোমুখি হতেই বললেন, অনেক দিন দেখা হয় না। আসেন একদিন, কথা আছে। একদিন আসবেন। তাঁর কাছে আর যাওয়া হয়নি। এখন বড় বেশি কষ্ট পাই।

চার.
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের এই আত্মত্যাগ, জীবন বিসর্জন—সবই এক গভীর বেদনা তৈরি করে আমাদের মধ্যে। একই সঙ্গে এই লড়াই, সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ আমাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে। আমাদের জাতীয় জীবনে তাঁরা আলোর দিশারি। এই সব লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পীকে কোনো দিন আমরা ভুলে যেতে পারি না। এটা কখনোই সম্ভব নয়।

এটা সত্য যে ১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে পালন করলেও স্বাধীনতাসংগ্রামের শুরু থেকেই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ, লেখক, শিক্ষক, শিল্পী, চিকিৎসকসহ প্রায় সব পেশার মেধাবীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের নিষ্ঠুর শাসকগোষ্ঠীর। সে জন্য আমরা দেখি, ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় হামলা চালিয়ে শিক্ষক–অধ্যাপককে হত্যা করা হয়েছে। পরে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্যত্র একই রকম নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে। এভাবেই স্বাধীনতার আগের দুই দশক ধরে জাতির বিবেককে জাগিয়ে তুলতে যাঁরা লেখা, গান, অভিনয় ও শিক্ষার মাধ্যমে দেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত রেখেছিলেন, তাঁদেরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। এই শহীদেরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য নানাভাবে কাজ করেছেন। বিজয়ের দিনটি দেখার জন্য তাঁরা উন্মুখ হয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁরা দেখে যেতে পারেননি। স্বাধীনতাসংগ্রামের ৯ মাসে তাঁদের অনেককে আমরা হারিয়েছি। কিন্তু আমরা পরাজিত হইনি। স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ী হয়েছি। সেই বিজয় অর্জনের জন্য আমরা সব সময় আমাদের শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ সব শহীদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তাঁদের স্মরণ করব ভবিষ্যতেও।

মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো