বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বনবাণী কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমার ঘরের আশপাশে যে-সব আমার বোবা-বন্ধু আলোর প্রেমে মত্ত হয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, তাদের ডাক আমার মনের মধ্যে পৌঁছল। তাদের ভাষা হচ্ছে জীবজগতের আদিভাষা, তার ইশারা গিয়ে পৌঁছয় প্রাণের প্রথমতম স্তরে; হাজার হাজার বত্সরের স্কুলে-যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়। মনের মধ্যে যে-সাড়া ওঠে সেও ঐ গাছের ভাষায়—তার কোনো স্পষ্ট মানে নেই, অথচ তার মধ্যে বহু যুগযুগান্তর গুনগুনিয়ে ওঠে।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তরুরাজির মনোজগতে প্রবেশ করার কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। আমরা দেখি, তাঁর গভীর ভাবনাবোধ জীবজগতের ভাষাজ্ঞানকে নিরন্তর পাঠ করার চেষ্টা করে। আসলে প্রাণজগতের সঙ্গে ভাববিনিময়ের কোনো বিকল্প নেই। যদিও এই বিনিময় অনেকটাই অদৃশ্য কিন্তু বৃক্ষসমাজে এর একটি গভীর প্রভাব আমরা লক্ষ করি। যদি একটি তরু শিশুকে পরম মমতায় বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে তার রূপ অনেকটাই আলাদা হবে। মূলত এই মমতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা ও বোঝাপড়ার মতো কিছু মৌলিক বিষয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে প্রাচীনতম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ বলেছেন, যেখানে যুগযুগান্তরের কথকতা গুনগুনিয়ে ওঠে, সেই বৃক্ষজগৎ আমাদের কাছে এখন চরম অবহেলিত এবং অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! যেন এ বিষয়ে কারও কোনো দায় নেই।
মূলত প্রতিবছরের জুন মাসে বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে ঘিরে একটি সংক্ষিপ্ত ও দায়সারা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই বৃক্ষবিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জুন মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে কিছু গাছ লাগিয়ে দিলেই যেন দায়িত্ব শেষ! সারা বছর এ বিষয়ে যেন আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নার্সারিতে উৎপাদিত লাখ লাখ চারার শেষ পরিণতি কী হয় তার খোঁজ আমরা অনেকেই জানি না। আসলে গাছ লাগানো কোনো দায়সারা গোছের কাজ নয়। রীতিমতো প্রযুক্তি ও পরিকল্পনানির্ভর একটি বিশেষায়িত কাজ। কারণ, গাছ সজীব ও সপ্রাণ। তাকে মাটিতে পুঁতে দিলে যে স্থির থাকবে, এমনটা আশা করা যায় না। সে তার প্রয়োজনমতো জায়গা দখল করবে। নানান কৌশলে খাবার সংগ্রহ করবে।
তা ছাড়া, বিশ্বব্যাপীই বৃক্ষায়ণ একটি শিল্প। উন্নত দেশগুলোতে পার্ক বা পথের পাশে আমরা যে একই আকৃতির গাছ দেখি তা কিন্তু পরিকল্পনারই অংশ। সম আকৃতির জন্য সেখানে একই জাতের গাছ পাশাপাশি রাখা হয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সে গাছগুলোর ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়। কোনো গাছ মারা গেলে বা হেলে পড়লে সেটি সরিয়ে একই জাতের এবং একই উচ্চতার গাছ পুনঃসংযোজন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, নগর কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিটি গাছেরই তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত থাকে। কোন গাছটি কোথায় কবে লাগানো হলো, কখন মারা গেল—এসব তথ্যও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
কিন্তু আমাদের শহরগুলোতে ৯০ শতাংশ গাছই লাগানো হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এমনকি নগরে এ বিষয়ে আলাদা কোনো বিভাগ কিংবা বিশেষজ্ঞও নেই। ফলে অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা এসব গাছপালা কখনো কখনো আমাদের জীবনে অভিশাপও হয়ে উঠেছে। প্রতিবছরই গাছের চাপায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। অথচ একটি গাছ লাগানোর পর থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এই পদ্ধতিতেই কেবল অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিকড়ের জরাগ্রস্ত গাছগুলো সহজেই সরিয়ে ফেলা সম্ভব। আরেকটু আন্তরিক হলে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যতার বিষয়টিও অগ্রাধিকার পাবে; যা আমাদের দেশে কখনোই বিবেচ্য হয়নি।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ঢাকার হাতিরঝিল বা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। যেখানে একটি গগনচুম্বী গাছের সঙ্গে লাগানো হয়েছে গুল্মজাতীয় গাছ। গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ছোট-বড় লতা ঝাড় কোনো কিছুই আমলে নেওয়া হয়নি। মানা হয়নি বৃক্ষায়ণের কোনো সূত্র। অথচ হাতিরঝিলের মতো একটি নান্দনিক স্থাপত্যের বৃক্ষশোভা কেমন হতে পারে—তা নিয়ে আমরা একাধিকবার লিখেছি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করেও বলেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ গ্রাহ্য করেনি। এখানে খুব সহজেই পরম কাঙ্ক্ষিত জারুল সোনালু কৃষ্ণচূড়ার একটি দীর্ঘ বীথি করা যেত; যা গ্রীষ্মের প্রকৃতিকে অনেক বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য করে তুলতে পারত। কিন্তু এখানেও আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। তৈরি হয়েছে আরেকটি বিশৃঙ্খল পথতরুর নজির। শুধু হাতিরঝিলই নয়, বৃক্ষায়ণের ক্ষেত্রে সড়ক বিভাজক থেকে শুরু করে সর্বত্রই এমন নৈরাজ্য চোখে পড়বে।
আসলে আমাদের আশপাশের গাছগুলো বেড়ে উঠছে অযত্নে, অবহেলায়। অভিভাবকহীন এসব গাছের কোনো হিসাব-নিকাশ আমাদের হাতে নেই। ফলে পঞ্চাশ বা এক শ বছর আগে এই শহরে কী কী গাছ ছিল, তা যেমন আমরা জানি না, তেমনি কোনো সমীক্ষা না চালালে আরও এক শ বছর পরেও কেউ জানবে না এখানে কোথায় কী ধরনের গাছ ছিল। চার শ বছরের পুরোনো এই শহরে কত বছর বয়সী কটি গাছ আছে, তাও কিন্তু আমরা জানি না।
এখন আমাদের অঙ্গীকার করা উচিত—বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ নিয়ে আর কোনো হেলাফেলা নয়। আশা করি নগর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আরও যত্নবান হবে। আমরা চাই শহরের বৃক্ষবিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হবে একজন বৃক্ষ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে। তাঁর অধীনে থাকবেন আরও কয়েকজন নির্ভরশীল ব্যক্তি। যাঁরা খুব সহজেই সঠিক গাছটি চিনতে পারবেন এবং ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন। এ বিষয়ে একটি উচ্চতর কমিটিও থাকতে পারে। যারা বার্ষিক কার্যক্রমের অনুমোদন দেবে। নগর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কিছু নার্সারিও থাকতে পারে, যা থেকে বিভিন্ন পার্ক ও পথপাশে চারা সরবরাহ করা হবে। সমগ্র কার্যক্রমটি পরিচালিত হবে আধুনিক পদ্ধতিতে। আমরা যেন একটি বাটন টিপেই জেনে নিতে পারি কোন সড়কে কতগুলো গাছ আছে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com