কাজী নজরুল ইসলামকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সাল
কাজী নজরুল ইসলামকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সাল

তরুণদের রোল মডেল কেন বঙ্গবন্ধু ও কাজী নজরুল

২০১০ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশ একটা জরিপ প্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ দ্য নেক্সট জেনারেশন’ শিরোনামে। ২০০৯ সালে বছরব্যাপী বাংলাদেশের তরুণদের ওপর করা এই জরিপে চমৎকার সব পর্যবেক্ষণ বেরিয়ে এসেছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ৮৮ ভাগ তরুণ ছিলেন সুখী কিংবা খুব সুখী, তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৬ ভাগ ছিলেন খুবই অসুখী। ৭৪ ভাগ তরুণ বলেছিলেন, তাঁরা রাজনীতিতে উৎসাহী নন। ৪১ ভাগ বলেছিলেন, তাঁরা বিদেশে যেতে চান। বিদেশে যেতে চাওয়ার কারণ বেশি উপার্জন বা লেখাপড়া করা কিংবা দেশে কাজের অভাব। খুবই আশার কথা ছিল, ৯৮ ভাগ তরুণ মনে করেন, তাঁদের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করা উচিত। ৯৫ ভাগ মনে করতেন, তাঁরা স্থানীয় ও সামাজিক কাজে অংশ নিতে আগ্রহী ও সক্ষম। ৭০ ভাগ তরুণ মনে করতেন, দেশটি সঠিক পথেই এগোচ্ছে। তবে বেশির ভাগের (৬০ ভাগ) শঙ্কা ছিল, দেশে দুর্নীতি বাড়বে। ওই সময় ৭৩ ভাগ তরুণের মুঠোফোন ছিল, ৮৫ ভাগ তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন না। বিটিআরসির ওয়েবসাইট অনুসারে এই মুহূর্তে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ।

২০০৯ থেকে ২০২১, প্রায় ১২ বছর চলে গেছে। আবারও এই দেশের তারুণ্যের মনমানসিকতা বোঝার জন্য একটা জরিপ হওয়া দরকার। সেই জরিপে আরও দুটো প্রশ্ন ছিল। দেশে তরুণদের রোল মডেল কে? বিদেশে তরুণদের রোল মডেল কে? দেশে রোল মডেল হিসেবে এসেছিল দুজনের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী নজরুল ইসলাম। বিদেশের রোল মডেল হিসেবে এসেছিল বারাক ওবামার নাম।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের এ–সংক্রান্ত একটি প্রকাশনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ লিখেছিলেন, ‘তরুণদের প্রেরণা আর উদ্দীপনা জোগাতে রোল মডেলদের ভূমিকাকে ছোট করে দেখা যাবে না। জরিপে জাতীয় পর্যায়ে দুজন রোল মডেলকে চিহ্নিত করেছেন তরুণেরা। একজন হলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যজন কাজী নজরুল ইসলাম। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, দুই ব্যক্তিত্বেরই আছে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক পরিচিতি। তার মানে হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের দার্শনিক ধারাটা আজকের তরুণদের মধ্যেও বহমান।’ তারেক মাসুদ আরও লিখেছিলেন, ‘তরুণদের বড় অংশ (৬৪ ভাগ) মনে করে, পরের পাঁচ বছরে দেশটার মৌলবাদী হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, সেটা থেকেও একই ধারণাই বেরিয়ে আসে।’

বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২০ সালে। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করলাম। এই ডিসেম্বরে আরেকটা শতবার্ষিকী আজকের অন্য আলোয় আলোচিত হচ্ছে। তা হলো কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার ১০০ বছর।

বাংলাদেশের তরুণেরা কেন তাঁদের রোল মডেল কিংবা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে এই দুজনকেই বেছে নিলেন? তারেক মাসুদ ঠিকই ধরেছেন। তবে আমরা ব্যাপারটাকে আরও স্পষ্টভাবে বলতে চাই, দুজনই লড়াই করেছিলেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসক, শোষক, ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সংগ্রাম করে, জেল-জুলুম বরণ করে এবং দেশের মানুষকে মুক্তির স্বপ্নে পাগলপারা করে তুলে আমাদের এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। কাজী নজরুল ইসলামও ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা লিখে মানুষকে পাগল করে তুলেছিলেন। জেলে গেছেন, গিয়ে লিখেছেন, ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল/ এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল।’

বঙ্গবন্ধু এবং কাজী নজরুল ইসলাম উভয়ই কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেননি, তাঁরা মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন, মানবতার মুক্তি চেয়েছিলেন, শোষিতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, লড়াই করেছিলেন। হিন্দু-মুসলিমের মিলন কামনা করেছিলেন এবং নারীমুক্তি চেয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন সর্বহারার পক্ষে, তাঁরা চেয়েছিলেন সাম্য।

আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য চর্যাপদ নয়, বৈষ্ণব গীতিকা নয়, সোনার তরী কিংবা গীতাঞ্জলি কোনোটা নয়, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগীতি হলো “আর দাবায়া রাখতে পারবা না”।’

সত্য বটে, আজও যখন মানুষের ওপরে মানুষের নিপীড়ন দেখি, আজও যখন রাস্তায় কিশোর বিদ্রোহীরা নেমে আসে, আজও যখন ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজপথে নামে তরুণদের দল, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রেরণা হয়ে বাজে ৭ মার্চের ভাষণ। ‘তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালি, অ-বাঙালি তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের ভাষণটাও ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান, তার একটা রূপকল্প তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই, তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’

‘একটা কথা, একটা কথা। আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি–ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়।...আমার রাষ্ট্রে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।...নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি—এই আশীর্বাদ, এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন।’

কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর কবিতা ও গানে মুক্তির কথা, ভালোবাসার কথা, সম্প্রীতির কথা, সাম্যের কথা, নারীমুক্তির কথা, তারুণ্যের জয়ের কথা, যৌবনের বন্দনা করে গেছেন। বাংলাদেশের তরুণেরা কাজী নজরুল ইসলামের গানে, কবিতায়, লেখায় নিজেদের মনের কথা খুঁজে পান। ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপের এই তথ্য আমাদের আশাবাদীই করে তোলে। এই দেশের তরুণেরা একজন কবিকে তাঁদের আদর্শ মনে করেন, সেটাই তো একটা শ্লাঘার বিষয়। তারও পরে সেই কবি আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, বিদ্রোহী কবিতার কবি, যে কবির কণ্ঠ অনুসরণ করে আমরা গাই—

‘সাম্যের গান গাই—/ আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বের যা–কিছু মহান সৃষ্টি চির–কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

এবং আছে তাঁর ‘বিদ্রোহী’।

‘মহা-বিদ্রোহী রণ–ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—/ বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত।’

বিবিসি বাংলার জরিপে বলা হয়েছিল, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন বঙ্গবন্ধু। বিবিসির সেই জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির জনক। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। দুজনেরই জন্ম-মৃত্যু দিবস আমরা জাতীয়ভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে পালন করি। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিজীবনে, জাতীয় জীবনে, রাষ্ট্রীয় পরিসরে এবং সমাজজীবনে বঙ্গবন্ধু এবং কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ আমরা মোটেও চর্চা করি না, তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করি না। আমি বারবার করে বলি, আমাদের উচিত বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমাদের দেখা নয়াচীন বারবার পাঠ করা, তার মর্ম উপলব্ধি করা এবং তাঁর আদর্শ বাস্তবে অনুসরণ করা। তাহলেই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হয়ে উঠবে।

আর আমরা যদি আমাদের জাতীয় কবির রচনাসমূহ মন দিয়ে পড়ে তা আমাদের হৃদয়ে গ্রথিত করে নিতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার ১০০ বছর পূর্তির ক্ষণে আমি বলব, আসুন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটাই বারবার পড়ি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খল ভেঙে ব্যক্তিমানুষের বড় হয়ে ওঠার ঘোষণা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিজয়ের ঘোষণা। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় যা আছে, ‘উই আর অল বর্ন ফ্রি। উই অল হ্যাভ আওয়ার ওউন থটস অ্যান্ড আইডিয়াস অ্যান্ড উই শুড অল বি ট্রিটেড দ্য সেম ওয়ে।’

শুধু আনুষ্ঠানিকতায় নয়, জীবনচর্যায় জাতীয়, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক জীবনে আমাদের রোল মডেলদের আদর্শসমূহ কায়েম করাটাই হলো এখন কাজ।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক