রোগব্যাধিতে নয়, শিশুরা বেশি মারা যাচ্ছে বড়দের অবহেলা, অবজ্ঞা আর নিষ্ক্রিয়তায়। নানা গবেষণা আর পর্যবেক্ষণ বলছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি মরছে পানিতে ডুবে। সাধারণত ১২ থেকে ১৫ মাস বয়সের মধ্যে শিশুরা হাঁটতে শেখে এবং নতুন এই অভিজ্ঞতার পুরোটাই তারা উপভোগ করতে চায়। ফলে পরিবারের বড়দের অমনোযোগিতা বা গাফিলতির কারণে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। হাঁটতে শেখা শিশুদের হঠাৎ দুর্ঘটনার আশঙ্কা এমনিতেই বেশি থাকে।
দুই বছরের ফুটফুটে শিশু মেধা এবার ঈদে মা–বাবার সঙ্গে ঢাকা থেকে নাটোরে গিয়েছিল। ঈদের আগে এক দুপুরে নিখোঁজ মেধাকে বিকেলে নানাবাড়ির পাশে পুকুরে পাওয়া যায়। ততক্ষণে মেধা লাশ হয়ে গেছে। আড়াই বছরের সাদিয়া চট্টগ্রাম থেকে মায়ের সঙ্গে কুড়িগ্রামের উলিপুরে ঈদ করতে গিয়েছিল। সেখানে বাড়ির নলকূপের গর্তের পানিতে ডুবে মারা যায়। পরিবারের সবাই নাকি এতই ব্যস্ত ছিল যে উঠানের নলকূপের উচ্ছিষ্ট পানি জমা করার ছোট্ট একটা গর্তে দিনেদুপুরেই মারা গেল শিশুটি, কেউ টের পেল না।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের রাউজানের পূর্ব গুজরায়। যশোরের চৌগাছায়। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার মরজারতপুর গ্রামে, সেখানে একসঙ্গে দুই বোন মারা যায়, ঈদের মেহেদি দেওয়া হাত ধুতে গিয়ে ডোবার পানিতে পড়ে।
বলতে গেলে ঈদের ছুটির আগে–পরে শুধু বড়দের অসতর্কতার কারণে অনেক শিশু চিরতরে হারিয়ে গেছে সারা দেশে। সব খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। আমাদের নজরে এসেছে মাত্র ৫০টি ঘটনা। শুধু যে পুকুর, ডোবা আর পানির গর্তে পড়ে শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ঘরের ভেতরে বালতির পানিতে ডুবেও শিশু মারা যাচ্ছে হরদম। ৬ মে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় বালতির পানিতে পড়ে মাহি আক্তার (১) নামের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। কেউ মেনে নিতে পারছিল না মাহির মৃত্যু। কিন্তু তিন বোন মা–বাবার কেউ একটু আগে তাকে নিয়ে, তার সুরক্ষা নিয়ে ভাবার ফুরসত পায়নি।
২৮ এপ্রিল বগুড়ার শেরপুরেও বালতিভর্তি পানিতে ডুবে এক বছরের শিশু হুমাইদ মারা যায়। সকালে হুমাইদের মা সংসারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় বাড়ির সবার অগোচরে সে পানিভর্তি বালতির মধ্যে একটি প্লাস্টিকের বোতল ফেলে দেয়। এরপর বোতলটি নিতে গেলে বালতির পানির মধ্যে শিশুটির মাথা ডুবে যায়। মাস ছয়েক আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বালতির পানিতে ডুবে মারা যায় দুই যমজ বোন সারা ও সাবা। তাদের বয়স হয়েছিল তিন বছর। ওই শিশুদের মা ও নানা জানান, দুজন বাথরুমে গিয়ে পানি দিয়ে খেলছিল। বড়দের আন্তরিক ও সচেতন তত্ত্বাবধান ছাড়া শিশুদের যেকোনো খেলা যে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, সেটা মা–বাবাসহ অন্যান্য অভিভাবককে বুঝতে হবে।
রাজধানীতে রোলার কোস্টার থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যুর খবর, ময়মনসিংহে বাসের জানালা দিয়ে পড়ে শিশুর প্রাণ যাওয়া, অটোরিকশায় থাকা অবস্থায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুর মৃত্যু—কেবল দুর্ঘটনা নয়, অভিভাবকদের অসচেতনতা আর অবহেলাও।
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানার পূর্ব চরকলা কুপা গ্রামের তিন বোন (বয়স ১১, ১০ ও ৭ বছর) ঈদের দিন এক ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। সেখান থেকে নিজের মতো বাড়িতে যাওয়ার জন্য রামগতি থেকে ভুল করে চট্টগ্রামগামী একটি বাসে উঠে পড়ে। ওই বাসে করে সন্ধ্যার দিকে তারা এ কে খান মোড়ে পৌঁছায়। সেখানে নামার পর কান্নাকাটি শুরু করে। ভাগ্য ভালো সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হেফাজতে নিয়ে অভিভাবকদের খবর দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে। মা-বাবা কী ভেবে বাসের পথে এই তিন শিশুকে ফুফুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দিলেন? ফুফুরা কেন তাদের ঠিক ঠিক ফেরার বাসে উঠিয়ে দিলেন না? আবার চট্টগ্রামগামী বাসের কন্ডাক্টর, চালক, যাত্রী কেউই খেয়াল করলেন না এই তিন শিশুর ভয়ংকর ভুল যাত্রা?
শুধু পারিবারিক পর্যায়ে নয়, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও শিশুদের ক্ষেত্রে এমন অবহেলা দেখা যায়। রোলার কোস্টার দুর্ঘটনা তার একটা উদাহরণ। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে পিকনিক স্পট জাতীয় উদ্যান আশুরার বিলের দৃষ্টিনন্দন কাঠের সেতুটি ভেঙে পড়ে ঈদের দিন। শিশুসহ ১৫–২০ জন দর্শনার্থী বিলের পানিতে পড়ে যায়। বিলে ধানের জমি থাকায় শিশুরা আঘাত পেলেও কেউ মারা যায়নি। সেতুটি আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বেশ কিছু খুঁটি, রেলিংয়ের কাঠ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এটা নিয়ে লেখালেখি ও মেরামতের আহ্বান জানানো হয়েছিল। বাজার অর্থনীতি তাতে বেজার হয়েছে, সাবধান হয়নি।
প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আগে–পরে অনেক শিশু–কিশোর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এখনো সেই ধারা চলছে। এদের কারোরই মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার বয়স হয়নি। কেউ দুলাভাই, কেউ মামা, কেউ চাচা বা বাবার কাছে একটু ঘুরে আসার আবদার করেছিল। মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে কোথাও দুই বা তিন বন্ধুকে নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে আর ফিরে আসেনি। কারও ঠাঁই হয়েছে কবরস্থানে, কারও হাসপাতালে।
জেনেশুনে এ রকম প্রাণঘাতী আবদারে সাড়া দেওয়ার ক্ষতি কেউ কি কখনো পোষাতে পারে?
ঢাকা থেকে তিন কিশোর মোটরসাইকেলে নড়াইলে যাচ্ছিল। ভাটিয়াপাড়ার কাছে এক দুর্ঘটনায় তিনটি প্রাণ ঝরে গেছে। ঢাকা থেকে এতটা রাস্তা গেল, ফেরি পার হলো, কেউ একবার তাদের লাইসেন্স চেক করল না! মহাসড়কে এক মোটরসাইকেলে তিনজন কীভাবে অনুমোদন করল হাইওয়ে পুলিশ? এগুলো কি গাফিলতি না অবহেলা কিংবা স্রেফ যা হচ্ছে তা হতে দেওয়া?
ফরিদপুরের সালথা থানার ওসি রোজার মধ্যে মসজিদে মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের জানিয়েছিলেন আসন্ন ঈদে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা। ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেলে চেপে দূরদূরান্ত থেকে বাড়িতে আসার ঝুঁকির কথা। পঞ্চগড়ের বোদা থানার ওসি খোলা ট্রাকে বা পিকাপে চড়ে ‘ডিজে’ পার্টি মার্কা ঈদ ফুর্তি রুখে দিয়েছেন। তরুণ–কিশোরদের থামিয়ে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছেন রাস্তা থেকে। এসব দেখে মনে হয়, আমাদের এখনো আশা আছে। আমরা পারব একটা শিশু–সংবেদনশীল দেশ গড়তে। টিকা আর প্রতিষেধকের সঙ্গে সঙ্গে বড়দের আচরণে গুণগত পরিবর্তন শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পারে।
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক nayeem5508@gmail.com