মতামত

তবে কি বাজিল বরিসের বিদায়ঘণ্টা

বরিস জনসন
ছবি: রয়টার্স

‘লাস্ট চান্স সেলুন’ বলে ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘শেষ সুযোগের দোকান’। এই প্রবাদের পেছনে একটি ঐতিহাসিক সত্য আছে। ১৮৬৯ সালে কানসাসের কাল্ডওয়েল শহর আর ইন্ডিয়ান রাজ্যগুলোর সীমান্তবর্তী অংশের শেষ প্রান্তের একমাত্র বৈধ মদ বিক্রির দোকানকে ‘লাস্ট চান্স সেলুন’ বলা হতো। কারণ, এরপর থেকে মদ ছিল অবৈধ। ধারণা করা হয়, ১৯৯২ সালে জনাথন ডিম্বলবি প্রথম এই প্রবাদ যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ব্যবহার করেন।

এই একই প্রবাদ প্রায় বছর ত্রিশেক পর যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে আবারও ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ বরিস জনসনের বেসামাল অবস্থা। তাঁর দলের পুরোনো নেতাদের কেউ কেউ তো বলেই দিয়েছেন, বরিসকে ক্ষমতা ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যদি তিনি এক বছরের মধ্যে নিজের অবস্থান ঠিকঠাক করতে না পারেন, তবে তাঁকে বিদায় নিতে হবে।

কিন্তু কী এমন হলো যে ক্ষমতায় আসার দুই বছরের ভেতরই বরিস জনসনকে ক্ষমতা থেকে সরতে হবে এমন কথা শুনতে হচ্ছে? আমার এই প্রশ্ন আসলে ‘পরিমাণ দোষে’দুষ্ট। প্রশ্নটা হওয়া উচিত কী কী ঘটেছে যে বরিসকে ক্ষমতা ছাড়তে হতে পারে?
উত্তর: কী ঘটেনি?

ঘটনার ফিরিস্তি শুরু করা যাক খুব সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়েই।
১৬ ডিসেম্বর নর্থ শ্রপশায়ারে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা বরিসের কনজারভেটিভ পার্টি লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কাছে প্রায় ছয় হাজার ভোটে হেরেছে। এই আসনেই গতবার ওয়েন পিটারসন প্রায় ২৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। যাঁরা জানেন না, তাঁরা হয়তো ভাবছেন, পিটারসন কি প্রয়াত? না, উনি প্রয়াত নন। পদত্যাগ করেছেন। আসলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, সংসদের ‘দ্য কমন্স স্ট্যান্ডার্ড’ কমিটির এক তদন্তে বের হয়ে এসেছে, পিটারসন তাঁর ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার করেছেন। এমপি পদে থেকে দুটি কোম্পানির হয়ে লবিং করতে গিয়ে তিনি এই দুষ্কর্মটি ঘটিয়েছেন। এমপি পদে থেকে এদিক-ওদিক ব্যক্তিগত কাজ করাটা ডাল-ভাত যুক্তরাজ্যের এমপিদের জন্য—এই যুক্তিতে বরিসের সরকার পিটারসনকে বাঁচাতে চেয়েছিল। এমনকি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে পিটারসনকে নিরপরাধও দাবি করেছিলেন বরিস। কিন্তু নিজের দলের এমপিদের চাপেই সেই সুর বদলাতে হয়েছে। পিটারসন এতে খুবই দুঃখ পেয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘নিজের বাকি জীবনটা তিনি রাজনীতির এই কণ্টকাকীর্ণ দুনিয়া থেকে দূরে থেকেই পার করতে চান।’ কিন্তু বিষয়টি এখানেই মিটে যায়নি। পদ শূন্য হলে তাতে উপনির্বাচন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই নির্বাচনের হারই এখন বরিসের জীবনমরণ সমস্যা। ব্রিটিশ মিডিয়া বরিসের দলের এই হারকে আক্ষরিক অর্থে সরকারকে দেওয়া ‘জনগণের লাথি’ হিসেবে বিবেচনা করছে।

বরিস জনসনের বেসামাল অবস্থা। তাঁর দলের পুরোনো নেতাদের কেউ কেউ তো বলেই দিয়েছেন, বরিসকে ক্ষমতা ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যদি তিনি এক বছরের মধ্যে নিজের অবস্থান ঠিকঠাক করতে না পারেন, তবে তাঁকে বিদায় নিতে হবে।

একটি হার কেন এত বেদনার? কারণ, এই আসন কনজারভেটিভদের দখলে ছিল প্রায় ২০০ বছর। শুধুই কি হার? না। এই হারের ধার গত কয়েক মাসের ঘটনাচক্রে বেড়েই চলেছে। নির্বাচনে দল হেরেছে ১৬ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর নিজেরই দলের প্রায় ১০০ এমপি বরিসের কোভিড ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ইস্যু করার বিপক্ষে পার্লামেন্টে ভোট দিয়েছেন। এ ঘটনাকে ক্ষমতায় আসার পর বরিসের বিরুদ্ধে নিজের দলের এমপিদের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০২১-এর গোড়ার দিকে অভিযোগ ছিল বরিস জনসন তাঁর সরকারি বাসস্থান ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ঠিকঠাক করতে নিজের দলের অর্থদাতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। বরিস এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও ৯ ডিসেম্বর ইলেকটোরাল কমিশন জানিয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি দানের তহবিল নিয়ে নির্বাচনের আইন ভঙ্গ করেছে। এমপিরা তাই স্ট্যান্ডার্ড কমিশনারকে চাপ দিচ্ছেন বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্ত করতে। এ ঘটনায় বরিসের দোষ পাওয়া গেলে হাউস অব কমনসে বরিস সাময়িকভাবে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হতে পারেন। বরিসের অ্যাথিকস অ্যাডভাইজার লর্ড গাইট ‘ফ্ল্যাট স্ক্যান্ডাল’-এর বিষয়ে বরিসের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, ব্যাখ্যা যদি গাইটের মনমতো না হয়, তবে তিনি পদত্যাগও করতে পারেন।

জিঙ্গেল বেল...জিঙ্গেল বেল... ক্রিসমাস গীত। কিন্তু বরিসের জন্য দুঃস্বপ্ন। বরিস জনসন কোনো দিনও হয়তো ক্রিসমাসকে তাঁর রাজনৈতিক বেদনা থেকে আলাদা করতে পারবেন না। ২০২০–এর ক্রিসমাস। গোটা দেশে লকডাউন। তখন কী চলছিল ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে? পার্টি করছিলেন বরিস? জনে জনে আজ এই প্রশ্ন। ‘শুধু পনির আর আঙুরের তিতা রস পান করেছিলেন সভাসদরা।’ সংবাদ সম্মেলনের অনুশীলনে ঠাট্টাচ্ছলে এই কথাই বলেছিলেন বরিসেরই প্রেস অ্যাডভাইজার অ্যালেগ্রা স্ট্রাটন।

কিন্তু বিধিবাম, ব্রিটিশ চ্যানেল ‘আই টিভি’র কাছে সে কথার রেকর্ড পৌঁছে যায়। সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে পরে সেই ক্লিপ। পদ ছাড়তে হয় উপদেষ্টাকে। সংসদকে জবাবদিহি করতে হয় এই বলে যে ‘না, আমি কিংবা আমরা কোনো ক্রিসমাস পার্টি করিনি। সামাজিক দূরত্বের নিয়মও ভাঙিনি।’ কিন্তু এরপর ছবি বের হয় বরিসের নিজের চালানো অনলাইন কুইজের। সেই কুইজে অংশ নিতে অনেকেই নাকি সশরীর ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে হাজির হয়েছিলেন। খোদ তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী (পরে যিনি সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত উপদেষ্টাকে চুমু খাওয়ার দোষে চাকরিচ্যুত হয়েছেন) সংবাদ সম্মেলনে দেশবাসীকে ক্রিসমাসে কোনো পার্টি না করার পরামর্শ দিয়ে দরজার পেছনে চলা পার্টিতে নাকি যোগ দিয়েছিলেন। ক্ষমা চাওয়াতেও রক্ষা হয়নি। গঠন করতে হয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্তের ভার দিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সায়মন কেইসকে। কিন্তু এখানেও দেখা মিলল শর্ষের ভেতরে থাকা ভূতের। সায়মন নিজেও নাকি গত ক্রিসমাসে একটি নয়, দুই–দুটি পার্টি করেছিলেন। আর যায় কই! আমি এই কলাম লিখতে লিখতেই জানা গেল সেই তদন্তের ভার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সায়মন।

এত এত রাশভারী অভিযোগের ভেতর কিছু হাস্যরসাত্মক ঘটনা ঘটানোর অভিযোগও আছে বরিসের বিরুদ্ধে। ২২ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বরিস ভাষণ দিয়েছেন। সেই ভাষণে তিনি গ্রেট ব্রিটেনের ব্যবসায়িক সাফল্যের উদাহরণ দিতে বেছে নিয়েছেন বাচ্চাদের কার্টুন ক্যারেকটার পেপা পিগ-কে নিয়ে বানানো ‘পেপা পিগ ওয়ার্ল্ড’-এর। সেখানে তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন মোজেসের সঙ্গে। বক্তৃতার মাঝেই ২২ সেকেন্ড ধরে হাতড়েছেন লিখে নিয়ে আসা বক্তৃতার কাগজ। কথা বলতে বলতেই মুখ দিয়ে করেছেন ইলেকট্রিক গাড়ির হাস্যকর শব্দ। বরিসের গোটা আচরণকে কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রি আখ্যায়িত করেছে ‘হালকা এবং অপেশাদারসুলভ’ হিসেবে।

এত এত অভিযোগের মধ্যে ব্যক্তিগত এবং পেশাদার সম্পর্ককে গুলিয়ে ফেলার অভিযোগও সামনে উঠে এসেছে। জেনিফার আরকারি নামের এক প্রযুক্তি উদ্যোক্তার সঙ্গে বরিসের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি ওই নারী তদন্তকারীদের তাঁর আর বরিসের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করার দ্বার খুলে দিয়েছেন। নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিও তদন্তের স্বার্থে উন্মোচিত করেছেন তদন্ত দলের কাছে। অভিযোগ আছে, বরিস ক্ষমতার জোরে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন মিস আরকারিকে। ঘটনার সত্যতা মিললে বরিসের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তও হতে পারে।

বরিসের ‘পতননামা’ শুরু করেছিলাম নির্বাচনে হার দিয়ে। শেষও করব হার দিয়ে। বরিসের প্রধানমন্ত্রীর আসনে সবচেয়ে শুরুর আঘাত এসেছিল ২০২১ সালের ১৭ জুন। চেশাম এবং অ্যামারশেম ছিল কনজারভেটিভদের জন্য নিরাপদ ঘাঁটি। সেই দুর্গও জিতে নিয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা। এখানে ভোটের ব্যবধান ছিল প্রায় আট হাজার।

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ব্রিটিশ রাজনীতিও এই থিওরির বাইরে নয়। কিন্তু এটাও সত্য যে ধীর পতনে ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ে। আর দুই বছর পরই পার্লামেন্ট ইলেকশন। যদিও বরিসের দলের হর্তা-কর্তারা বরিসকে দিচ্ছেন এক বছর সময়। আর এই সময়ের ভেতরই বোঝা যাবে, বরিসের সামনে কি সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হবে, নাকি তৈরি হবে ‘শেষ সুযোগের দোকানে’ বসে শেষবারের মতো শেষ তেতো পানীয় পানের সম্ভাবনা?

রিনভী তুষার রাজনীতি গবেষক ও যুক্তরাজ্যে কর্মরত অভিবাসন উন্নয়নকর্মী
tushar.rinve@gmail.com