বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায়ই খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে ধর্ষণ, খুন, যৌন হয়রানি, রাহাজানির কথা এবং ঘাতক চালক কর্তৃক মৃত্যুর ঘটনা। বেপরোয়া গাড়িচালকের কারণে স্কুলছাত্র বা পথচারীর মৃত্যুর ঘটনা কিংবা যৌন নিপীড়নের পর পুড়িয়ে মারার ঘটনা যেন নিত্যদিনের ঘটনা। কিছুদিন আগেও কি আমরা এমন খবর নিয়মিত শুনতে পেতাম? কিছুদিন আগেও কি আমরা একজন বয়স্ক লোকের দ্বারা চার বছরের শিশুকে ধর্ষণের কথা শুনতাম? অথবা কিছুকাল আগেও কি আমরা সন্তানের দ্বারা পিতা বা মাতাকে হত্যার কথা শুনতাম? তাহলে সমাজে এখন কী হচ্ছে? আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কি একেবারেই শেষ হয়ে যাচ্ছে? নতুন প্রজন্ম এসব খবর দেখে কী ভাবছে? আর কীই–বা শিখছে?
আমাদের সমাজে এগুলোই কি স্বাভাবিক ঘটনা! এমনটি কি ঘটতেই থাকবে? আসলে সমাজে এই পরিবর্তনের মধ্যে কিছু কারণ আছে। একদিকে যেমন ইন্টারনেট সুবিধার কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক সহজ হয়েছে, তেমনি অবাধ তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সেক্স, ভায়োলেন্স, মাদকের ব্যবহার ইত্যাদি তরুণ-যুবসমাজের কাছে অতি সহজে পৌঁছে যাচ্ছে এবং সহজলভ্য হচ্ছে। ফলে, তাদের সেসব বিষয় অনেক প্রভাবিত করছে। এখন চেষ্টা করেও তারা সেই যোগাযোগমাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। জড়িয়ে যাচ্ছে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে। অন্যদিকে, দেশের ভেতরে অবাধে মাদকের বাজার সৃষ্টি হয়েছে, এর ব্যবহার শিশু, তরুণ, যুবক, বয়স্ক মানুষ—সবার মধ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা না ভেবেই তারা মাদক গ্রহণ শুরু করছে। ইয়াবা নামক যে মাদক এখন মিয়ানমার থেকে আমাদের দেশে ঢুকছে, তা বর্তমানে বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রামে, সব ওলিগলিতে সহজলভ্য হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন থেকে এই ইয়াবা ব্যবসা চলতে থাকায় এবং মোটা অঙ্কের লাভের বিষয়টি জড়িত থাকায় সমাজের বিত্তশালীদের একটি অংশও এই ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করে আসছে। কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না মাদক ইয়াবার চোরাচালান। মাদকদ্রব্য, বিশেষ করে ইয়াবা বিক্রি বন্ধ হয়নি। বন্ধ না হওয়ার পেছনে মূল কারণ, চাহিদাটা রয়ে গেছে। সে চাহিদা যাদের আছে, তারা তো যেকোনো মূল্যে পাওয়ার চেষ্টা করে। যারা আগে সহজে পেত, এখন তাদের বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।
ইয়াবা গ্রহণ করলে মানুষের মস্তিষ্কেও সব স্বাভাবিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেই মাদক গ্রহণকারীর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। রাসায়নিক চরিত্র, শক্তি, কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়া বিচারে অ্যামফিটামিন, মেথামফিটামিন কিংবা কোকেনের চেয়েও ইয়াবা শক্তিশালী উচ্চমাত্রায় উত্তেজক মাদকদ্রব্য। ইয়াবা গ্রহণকারী যেমন অন্যকে অবলীলায় খুন করতে পারে, তেমনি নিজেও সামান্য আবেগে আত্মহত্যা করতে পারে। এ ধরনের মাদক গ্রহণের কারণেই একজন মানুষ স্বাভাবিক সব কর্মকাণ্ড করে না। তখনই সে মাদকের কারণে যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। অর্থাৎ তার মধ্যে সব অস্বাভাবিক, নিয়মবহির্ভূত, বেআইনি, অসামাজিক আচরণ দেখা যায়। ফলে, সে তখন বেপরোয়া গাড়ি চালায়, নিরীহ পথচারী নিহত হয়। সে তখন নেশা কিনতে সামান্য টাকার জন্য বাবা, মা, ভাই, বোনকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। নেশাগ্রস্ত হয়ে একজন মেয়েকে যৌন উত্তেজনা বা ধর্ষণের মতো কাজ করতে সামান্যতম বিচলিত হয় না।
তাই সমাজে এ ধরনের অপকর্ম যারা করছে, তারা প্রকৃতিস্থ নয়, তারা স্বাভাবিক মানুষ নয়, তাদের মস্তিষ্কের মধ্যে শুধু মাদকের নেশার উত্তেজনা। সুতরাং, সমাজে যখনই কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজ সংগঠিত হয়, তখনই তাদের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই ডোপ টেস্ট বা ড্রাগ টেস্ট করা জরুরি।
সম্প্রতি সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে এখন থেকে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে। যাদের ডোপ টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হবে, তিনি চাকরির জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। সম্প্রতি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সময় সন্দেহ হওয়ায় ডোপ টেস্ট করার পর ১৮ জনকে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এমনই আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদকাসক্তির অভিযোগ নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং এদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে যদি নিয়োগের সময় ডোপ টেস্ট করা হয়, তবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী উভয়ই সচেতন হবেন এবং তাঁদের মধ্যে ভীতি তৈরি হবে। তা ছাড়া নতুন যাঁরা চাকরিতে আসবেন, তাঁদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক হলে এ সমস্যা অনেক কমে আসবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ডোপ টেস্টের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করলে যুবসমাজের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে মানবিক মূল্যবোধ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনা বেশি হচ্ছে একমাত্র মাদকের সহজলভ্যতার পর থেকেই। যেহেতু ইয়াবা নামক মাদক বহুকাল আগে থেকেই একটি ক্রেজি ড্রাগ বা ভয়ংকর উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ড্রাগ হিসেবে পরিচিত এবং এটি এখন বেশির ভাগ তরুণ ও যুবসমাজ এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, সেহেতু এই মাদকের অস্তিত্ব এসব খুনি, ধর্ষক, যৌন হয়রানিকারক ব্যক্তি ও ঘাতক চালকের মধ্যে পাওয়া যায় কি না, তা দেখা জরুরি সময়ের দাবি।
অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী: চিকিৎসক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা), সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স।
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com