আমরা এখন তথ্যের যুগে বাস করি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র বিষয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তথ্যের সর্বব্যাপী ভূমিকা রয়েছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ হাজারের বেশিবার গুগলে সার্চ করা হয়, ২৬ লাখের বেশি ই-মেইল করা হয়। প্রতি মিনিটে টুইট করা হয় পাঁচ লাখের মতো। তথ্যের যুগে যার কাছে তথ্য যত বেশি, সে তত বেশি ক্ষমতাবান। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে একটা রাষ্ট্রের তুলনায় একটা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বেশি হতে পারে। তবে তথ্য ব্যবহার করে গবেষণা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষের কল্যাণে যেমন ব্যবহার করা সম্ভব, তেমনি তথ্যকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়ে অসৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে এবং শত্রুকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়।
তথ্যের যুগে এসে তথ্যের মহাসড়কে প্রবেশের ক্ষমতা যার আছে এবং তথ্য যে নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। আমাদের তথ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের এখন প্রয়োজন নতুন নতুন তথ্য। ফলে তথ্য সংগ্রহের প্রচলিত যে প্রক্রিয়া ছিল, তা ভেঙে গেছে। আমরা এখন ২৪ ঘণ্টায় কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে মাত্র একবার তথ্য পেয়ে সন্তুষ্ট নই। আমাদের প্রতি মুহূর্তে তাৎক্ষণিক সর্বশেষ সংবাদ চাই। তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমগুলোতেও পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে। একটি বিশাল জনসংখ্যার কাছে এখন সংবাদের প্রধান উৎস রেডিও, টেলিভিশন বা সংবাদপত্র নয়, তাদের তথ্যের উৎস ইন্টারনেট, যা তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্মার্টফোন থেকে পাওয়া যায়।
তথ্যের প্রবাহেও এসেছে পরিবর্তন। আগে তথ্যের প্রবাহ ছিল একমুখী। আমাদের তথ্য পাওয়ার জন্য তথ্যের একমাত্র সরবরাহকারী সরকারি বেতার কিংবা টেলিভিশনের ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন আমাদের তথ্য পাওয়ার অসংখ্য উৎস রয়েছে। গতানুগতিক বাসগুলোর ধরনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে নতুন অনেক উৎস উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে মানুষ একই সঙ্গে তথ্যের ভোক্তা ও সরবরাহকারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে স্ট্যাটাসটা আমি এখন আপডেট করছি, সেটা কয়েক মিনিটের মধ্যে ভাইরাল হয়ে কোটি কোটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব কারণে তথ্যের ওপর রাষ্ট্রের যে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেটা এখন আর নেই। সরকার যদি তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, সেটা কোনোভাবেই সফল হবে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব হলেও ডিজিটাল তথ্যজগতে সেটা একদম অসম্ভব।
তথ্যের ভালো দিকগুলো যেমন অস্বীকার করার সুযোগ নেই, তেমনি এর অনেক নেতিবাচক দিকও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় আমরা প্রতি মুহূর্তে আমাদের জানা এবং অজানা অসংখ্য ডেটা তৈরি করছি। যে ডেটা তৈরি করছি, এমনকি তা ডিলিট করলেও কোথাও সেটা সংরক্ষিত থেকে যায়। এই তথ্যগুলো বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ করে এবং কাজে লাগায়। ফলে আমাদের ‘ডিজিটাল পদচ্ছায়া’ বিশ্লেষণ করে খুব সহজেই আমাদের পছন্দ, অপছন্দ, ভয়ভীতি, এমনকি দুর্বলতার জায়গাগুলো নির্ণয় করা সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমানে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’-এর ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটছে, যেগুলো মানুষের বিভিন্ন ক্ষুদ্র তথ্য বিশদভাবে সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে আমাদের বিরুদ্ধেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। যার মানে হচ্ছে, আমাদের সরবরাহ করা তথ্যই আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তথ্য আগ্রাসনের মূল মাধ্যম হলো ইন্টারনেট; বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের একটা ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে টার্গেট করে, অনেক ক্ষেত্রে ‘মাইক্রো-টার্গেটিং’ এবং তাদের ওপর প্রচারাভিযান চালিয়ে তাদের নির্দিষ্ট একটা মতাদর্শের দিকে ঝুঁকিয়ে ফেলা সম্ভব; অর্থাৎ সব মানুষের জন্য একই রকম তথ্য সরবরাহ না করে, তাদের চাহিদামাফিক তথ্য-মেনু সরবরাহ করে তাদের চিন্তাধারা প্রভাবিত করা এবং অনেকাংশে বদলে দেওয়া সম্ভব। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনটি সম্ভাব্য টার্গেট ব্যক্তিকে একেবারে ব্যক্তিপর্যায়ে গিয়ে মতাদর্শ সরবরাহ করেছে এবং সদস্য বানিয়েছে।
সারা বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করলে আমরা তথ্যের উল্লিখিত ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাব। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের হয়ে কাজ করেছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামক একটা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে প্রায় নয় কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেছিল এবং সেটা বিশ্লেষণ করে নির্বাচনী প্রচারাভিযান পরিচালনা করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়াভিত্তিক হ্যাকাররা ম্যানিপুলেট করেছিল। তারা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে কিছু ভুয়া তথ্য প্রকাশ করেছে এবং প্রোপাগান্ডা ট্রল করেছে, যার ফলে নির্বাচনকালীন তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে গতানুগতিক যুদ্ধের পাশাপাশি তথ্যযুদ্ধও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে সংঘটিত রাশিয়া-জর্জিয়ার মধ্যকার যুদ্ধে আমরা দেখেছি কীভাবে তথ্যযুদ্ধকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলামিক স্টেট ইন্টারনেট প্রোপাগান্ডাকে একটা নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রোপাগান্ডা ভিডিওর মাধ্যমে সারা বিশ্বের তরুণদের জিহাদে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
বিশ্বের যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশও তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত ঝুঁকিতে আছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ঢাকা শহর ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে সারা বিশ্বে দ্বিতীয়। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি। ১৩ কোটি মুঠোফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ৬ কোটি মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। যাঁদের নিজেদের ইন্টারনেট যুক্ত মুঠোফোন নেই, তাঁরা ‘দ্বিতীয় ব্যবহারকারী’ হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। ফলে বিপুলসংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতি মুহূর্তে যে অসংখ্য ডেটা তৈরি করছেন, সেটা বিশ্লেষণ করে তাঁদের কাছে পৌঁছানো এবং এমনকি প্রভাবিত করা সম্ভব।
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ বড়সড় সাইবার ডাকাতির শিকার হয়েছে। খোয়া যাওয়া অর্থের অধিকাংশই এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রের খবর অনুসারে আমাদের দেশে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৩ জুলাই প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি কীভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ফেসবুকে ট্রল ও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু ২০১৮ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাই এই মুহূর্তে ঝুঁকির মাত্রাটাও বেশি। যেহেতু ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বাংলাদেশের মানুষজন এখন ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, ফলে এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করা এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক কিংবা উগ্র মতাদর্শে ধাবিত করা খুব সহজেই সম্ভব। ‘বিগ ডেটা’ এবং ‘ডিপ ডেটা’র ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের গভীর তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। এ ছাড়া ‘ডেটা মাইনিং’ এবং ‘ডাটা ক্রাঞ্চিং’ ব্যবহার করে বিদ্যমান বিপুল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন তথ্য উত্পাদন করা সম্ভব। নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে গভীর তথ্য সংগ্রহ করে তাদের কাছে ভুয়া খবর ও ভিডিও সরবরাহ করে তাদের প্রভাবিত করা এবং একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের দিকে ধাবিত করা সম্ভব।
ইদানীং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংকুচিত পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে, তার কারণে অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ডিজিটাল অঙ্গনে স্থানান্তরিত হবে। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের প্রায় তিন কোটি ভোটার রয়েছেন, যাঁদের সিংহভাগই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। গতানুগতিক মিছিল-মিটিং থাকবে, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর মূল মাধ্যম হবে ইন্টারনেট। জানা গেছে, ইতিমধ্যেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীকে সামাজিক যোগাযোগ অ্যাকাউন্ট চালু করতে এবং সক্রিয় হতে নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও ইন্টারনেটের দিন দিন ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। গ্রামাঞ্চলের বিপুল মানুষের কাছে ফেসবুকই হচ্ছে ইন্টারনেট। আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, ফেসবুককে নির্বাচনের সময় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া অনলাইনের ক্ষমতা অফলাইনেও কার্যকর করা সম্ভব হবে ‘তথ্য ফেরিওয়ালা’র মাধ্যমে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যযুদ্ধ, তথ্য আগ্রাসন, লক্ষ্যাভিমুখী ভুয়া খবর, প্রচারণা ইত্যাদির ব্যবহার বাড়বে। খুদে বার্তা ও ভিডিও মেসেজ পাঠানো, একসঙ্গে অসংখ্য বার্তা পাঠানো ও বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে তথ্য পাঠানোর মাধ্যমে এটা ঘটবে।
নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের সম্যক জ্ঞান রাখতে হবে, যাতে কোনো বিভ্রান্তিকর সাইবার প্রচারণার মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনো চ্যালেঞ্জের মধ্যে না পড়ে। এ জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন হলেই চলবে না, সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মকর্তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করতে হবে। তথ্যের যুগে বসবাস করে তথ্যের অপার ক্ষমতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাই তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে এর ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগানোর পদ্ধতি অবলম্বন করা শ্রেয়।
মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজজামান (অবসরপ্রাপ্ত): ঢাকায় অবস্থিত নিরাপত্তা চিন্তাশালা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি