অলংকরণ
অলংকরণ

মতামত

‘তথাকথিত’ রাজনীতিবিদে ভরে গেছে দেশটা

পাপিয়া দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ফল—এই মন্তব্য করেছেন আদালত। তবে এই সত্য আমরা সবাই জানি, কিন্তু খুব একটা বলি না। আর বললেও তা শোনার কেউ নেই। যাঁদের হাতে রাজনীতি, যাঁরা এটা ঠিক করার দায়িত্বে তাঁদের ক্রমাগত পিছু হটার ফলে রাজনীতিবিমুখ বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা।

আদালতের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘তাঁরা তথাকথিত রাজনীতিবিদ। রাজনীতির ছদ্মাবরণে তাঁরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দেশের জন্য তাঁরা মারাত্মক বিপজ্জনক।’ পর্যবেক্ষণের প্রতিটি বাক্যে আছে ধারালো বার্তা। নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী পাপিয়া এবং তাঁর স্বামী সুমনকে অস্ত্র মামলায় ২০ বছর করে সাজা দিতে গিয়ে আদালতের এসব মন্তব্য ওই দুজন ছাড়াও অনেকের বেলায়, অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

মানুষ পাপ নিয়ে জন্মায় না। পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাকে পাপের দিকে ঠেলে দেয়। পাপিয়ার মতো ‘তথাকথিত রাজনীতিবিদেরা’ এর বড় উদাহরণ। তাঁদের মতো রাজনীতিবিদে ভরে গেছে দেশটা। রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিত্তের সখ্য এতটাই প্রকট যে প্রকৃত রাজনীতি বা রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অর্থনীতিতে যেমন ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস অ্যাওয়ে গুড মানি’, রাজনীতির চিত্রটাও তেমনি। ত্যাগী ও প্রকৃত রাজনীতিবিদদের অনেকেই দূরে সরে যাচ্ছেন, দুর্বৃত্তরা ক্রমে জায়গা পোক্ত করেছেন। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতে, তাঁরা কাউয়া, অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড বা ফার্মের মুরগি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় দলে অনুপ্রবেশকারীদের সতর্ক করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলেরই মাঠের কিছু নেতা সুবিধা গ্রহণসহ নানা বিবেচনায় প্রভাবশালীদের দলে ভেড়াচ্ছেন। এমনিতেই দল অনেক দিন ক্ষমতায় থাকায় স্থানীয় কিছু নেতা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তার ওপর অনুপ্রবেশকারীরা জায়গা করতে গেলে স্থানীয় রাজনীতিতে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

সম্রাট থেকে পাপিয়া, সাহেদ থেকে সাবরিনা, দুই ভাই বরকত-রুবেল, ক্যাসিনো কারবারি দুই ভাই এনাম-রুপন, শামীম-খালেদ—এমন সব ঘটনার পেছনেই রয়েছে কথিত রাজনীতি। মাঠের রাজনীতি তো আর নেই, এখন তা চলে গেছে পকেটে। এখন রাজনীতি মানে ক্ষমতার দাপট এবং বেপরোয়া দুর্নীতি।

রাজনীতিতে এখন আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার প্রবণতাটাও লক্ষণীয়। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসককে হুমকি ও নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের গালিগালাজ করার অভিযোগ স্বতন্ত্র সাংসদ নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এই সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের রাজনীতিতে ওই সাংসদ জনপ্রিয় সন্দেহ নেই, কিন্তু আইন লঙ্ঘন করতে পারেন না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের কারও পক্ষপাত বা গাফিলতি থাকলে সেটিও খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

দুর্নীতি কমাতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু রাজনীতি তো ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং তা খুবই লাভজনক ব্যবসা। সাংসদদের বেশির ভাগই এখন ব্যবসায়ী। টাকার জোরে সাংসদ হওয়ার ভূরি ভূরি নজির চারদিকে।

পাবনার বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আনাম সিদ্দিকীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন বেড়া পৌরসভার মেয়র মো. আবদুল বাতেন। গত বুধবার ইউএনও বাদী হয়ে বেড়া থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ওই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে। চাঁদপুরের কচুয়ায় প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনায় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান শিশিরকে বরখাস্ত করা হয়।

দেশের অনেক এলাকায় এখন এমন চিত্র; কিছুদিন পরপর এসব ঘটনা ঘটছে। পুলিশ ও প্রশাসন কাজ করতে পারছে না স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের চাপে। কোথাও কোথাও মিলেমিশে এবং সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করে চলছে স্থানীয় একশ্রেণির রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও প্রশাসন। একটি জেলা বা উপজেলায় এই তিনটি অংশ যখন ব্যক্তিস্বার্থের বন্ধনে এক হয়, তখন কারও কিছুই করার থাকে না। ওই জেলা-উপজেলার মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে যায়, যেমনটি হয়েছিল ফরিদপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায়। ওই দুটি জেলায় সরকারের সাম্প্রতিক ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। সরকারের এখনকার নজর সিরাজগঞ্জের দিকে, সেখানকার স্থানীয় নেতাদের আমলনামা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। প্রতিপক্ষের হামলায় আহত সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক বিজয় কিছুদিন আগে মারা যাওয়ার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেখানেও শুদ্ধি অভিযান চলতে পারে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য এসব অভিযান গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সারা দেশে কমবেশি ক্ষমতার দাপট ও দৌরাত্ম্য চলছে। এ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করাটা জরুরি।

আসলে ক্ষমতায় থাকতে কেউ বোঝে না, যেমন বোঝেনি বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা জামায়াতে ইসলামী। নব্বই-পরবর্তী সময়ে বিএনপি বা ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সেই দেখে নেওয়া বা পিষে ফেলার চেহারা অনেকেরই মনে আছে নিশ্চয়ই। হাওয়া ভবনের নাম সংবাদপত্রে লেখা যেত না, কৌশলে লিখতে হতো ‘একটি বিশেষ ভবন’। স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের ৯ বছরের দুঃশাসন কেউ ভুলে যায়নি, দলটি এখন অস্তিত্বের সংকটে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের হুংকার এবং দলটির দুই নেতার গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ার সেই দৃশ্য এ দেশের আপামর মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।

সেসব অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু, যা প্রায় এক যুগ চলছে। এই সময়ে জঙ্গিবাদ অনেকটাই দমন হয়েছে, মানবতাবিরোধী বড় অপরাধীদের সাজা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, করোনাকালে চাপা পড়লেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে অর্থনীতি। কিন্তু ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’ অবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক, ব্যাংকসহ প্রভৃতি খাতে সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। যেটুকু ভালো কাজ, যতটা উন্নয়ন—তার অনেকটাই দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি চুষে খাচ্ছে। এই রাজনীতিই এখন উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অগ্রগতির শত্রু।

এখন যাঁরা যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, তত বেশি ক্ষমতাবান। আদাব-সালাম বেশি পান তাঁরা। অস্ত্রধারী, স্তাবক ও লাঠিয়াল দিয়ে বেষ্টিত থাকেন। ত্রাস সৃষ্টি করা, মানুষকে ভয় দেখানো, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ-গণধর্ষণ, খুন, অঙ্গচ্ছেদ, রগ কাটা, কবজি কর্তন, হত্যা, গুম, নির্যাতন—এসব অপরাধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জড়িত হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতাদের অনেকেই। এই পরিস্থিতিতে মনে পড়ছে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের একটি বক্তব্য, ‘রাষ্ট্র আজ বাজিকরদের হাতে চলে গেছে।’

জাতীয় সংসদ ভবন

রাজপথ দখলে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সন্ত্রাসী পোষে, এটা নতুন কিছু নয়। সরকারি দলের পক্ষে এই কাজটা করা বেশ সহজ। ফলে মাস্তানেরা সচরাচর ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গেই থাকে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল, তদবিরসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সহজ। ফুটপাতের ঠিকাদার হিসেবে পরিচিতদের অনেকেই গত এক দশকে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে মাস্তানদের অনেকেই সাংসদ, উপজেলা বা পৌরসভার চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনীতিতে ক্রমাগতভাবে মাস্তান ও বিত্তবানেরা আসতে থাকায় সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত নেতা-কর্মীরা এই অঙ্গনে হয় কোণঠাসা, না হয় বিতাড়িত।

সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। ১৯৯১ সালে ৩৮ শতাংশ ব্যবসায়ী সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫৮ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৫৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৫৯ শতাংশ এমপি সাংসদ হন। বেসরকারি একটি গবেষণা অনুযায়ী, এখনকার সংসদে ৬১ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী। এভাবে আইনজীবী, শিক্ষক, কৃষিজীবীসহ অন্য পেশার প্রাধান্য সংসদে ক্রমাগত কমেছে, বেড়েছে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাণী-বিবৃতির সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতির প্রতিক্রিয়া যদি তাঁরা বুঝতেন বা বোঝার চেষ্টা করতেন, তাহলে এগুলো আর বলতেন না। সরকার দলীয় কিছু নেতার ক্ষমতার দম্ভে বড় বড় কথা, আর সরকারবিরোধীদের বক্তৃতায় তর্জন-গর্জন ভাব—এসবই এখনকার রাজনীতি। এই রাজনীতি মানুষের জন্য নয় বা দলের জন্য নয়; নিজেদের জন্য, আরও স্পষ্টভাবে বললে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। যত বড় কথা, বাস্তবে কাজ কিন্তু তত কম।

দুর্নীতি কমাতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু রাজনীতি তো ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং তা খুবই লাভজনক ব্যবসা। সাংসদদের বেশির ভাগই এখন ব্যবসায়ী। টাকার জোরে সাংসদ হওয়ার ভূরি ভূরি নজির চারদিকে। নইলে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়া কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুল ও তাঁর স্ত্রীর সংসদ সদস্য হওয়ার কথা নয়। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে, যাঁরা আজ প্রভাব ও টাকার জোরে সাংসদ বা জনপ্রতিনিধি। সৎ ও ভালো মানুষের পক্ষে প্রভাবশালী ও বিত্তবানের সঙ্গে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে পেরে ওঠার কথা নয়, পারেনও না।

দুর্নীতি বন্ধ করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তার আগে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। পাপিয়ার মতো ‘তথাকথিত’ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার সিঁড়িতে উঠতে দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কি যথেষ্ট? দুর্নীতি দমন কমিশন কি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে? যারা দুর্নীতি করে এবং যারা এটাকে প্রশ্রয় দেয়—উভয়ই অপরাধী। প্রশ্রয়দাতাদেরও খুঁজে বের করতে হবে। আবার বের করলেই হবে না, ধরতে হবে। বেসিক ব্যাংক কে চুষে খেয়েছে, তাঁকে দেখে না দেখার ভান করলে হবে না। ফারমার্স ব্যাংককে কি কেবলই নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুব চিশতী গিলেছেন, আসল রাঘববোয়ালটা কে—এটা কি কারও অজানা? একদিকে অজানা দুর্নীতি খুঁজতে হবে, আর জানা দুর্নীতি চাপা দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হলেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে, এটা বলা যায় না, তবে সিংহভাগ দুর্নীতি তো বন্ধ হবে। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হলে প্রশাসনিক দুর্নীতিসহ পুলিশ, বিচারালয়সহ সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে।

শরিফুজ্জামান: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

pintu.dhaka@gmail.com