নতুন নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়েছে। আর সব বারের মতো এবারও আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে আছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কমিশনের কাজের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তের প্রয়োজনে সিইসির ভোট আর সব কমিশনারের সমান হলেও কমিশনারদের সভায় যেহেতু তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং কমিশন সচিবালয় যেহেতু তাঁর অধীনে থাকে, তাই তাঁর কিছু বড় ভূমিকা তো আছেই। বাংলাদেশের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সিইসি–ই আসলে নির্বাচন কমিশনের চরিত্র ঠিক করেন।
বিসিএস ১৯৮১ ব্যাচের কর্মকর্তা সিইসি সরকারি চাকরি শুরু করেন মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে। এরপর জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শেষে আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ধাপে ধাপে একই মন্ত্রণালয়ের সচিব হন তিনি। পরে তিনি ধর্ম, সংসদ সচিবালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এখানে লক্ষণীয় হলো, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে হাবিবুল আউয়ালের নিয়োগের সময় নীতিমালা মানা না হওয়ায় আদালত তাঁর নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে ২০১০ সালে।
নবনিযুক্ত সিইসিকে ধন্যবাদ দিতে চাই। নিজের অজান্তেই তিনি দেশে একটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রমাণ করলেন। এটা কোনো তাত্ত্বিক আলোচনার পর্যায়ে আর নেই। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, নানা রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়ে এই দেশের নাগরিকেরা জানেন, এ দেশে একটা ক্ষমতাসীন সরকার কখনো নির্বাচন কমিশনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে না
শুধু সেটাই নয়, আইনসচিব থাকা অবস্থায় বিধিবহির্ভূতভাবে দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়েও জটিলতায় জড়িয়েছিলেন হাবিবুল আউয়াল। সংসদীয় কমিটি এ জন্য তাঁকে তলব করলে তিনি সে ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমাও চান। এসব হচ্ছে এখন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর চাকরির অনিয়ম। সিইসি তো বটেই, একজন কমিশনার হওয়ার পথে তাঁর চাকরির এই অনিয়ম নিশ্চয়ই বাধা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আছে এর চেয়ে বড় সমস্যা।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল হাবিবুল আউয়ালের। কিন্তু পিআরএল বাতিল করে তাঁকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১৬ সালে আরও এক বছর বাড়ানো হয় চুক্তির মেয়াদ। এরপর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেই জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে ২০১৭ সালে অবসরে যান তিনি। সরকারের কোনো কর্মকর্তাই অপরিহার্য নন। ধাপে ধাপে যেভাবে কর্মকর্তারা প্রশিক্ষিত হয়ে আসেন, তাতে একজনের অবসর গ্রহণের পর অপরজন দায়িত্ব খুব ভালোভাবেই নিতে পারেন। তাই যখন কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়, সেটা সেই মানুষটার বিকল্প না থাকার কারণে হয় না। সচেতন মানুষমাত্রই জানেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারের (রাষ্ট্রের নয়) অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সরকারকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে।
কোনো সরকারের অনেক বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনার হিসেবেই অযোগ্য। সেখানে সিইসি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সরকারের এমন সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রাথমিক বাছাইয়েই বাদ পড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যা হলো, তাতে আমরা বুঝলাম নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এত শোরগোলের মধ্যেও সরকার অন্তত ‘আইওয়াশ’ দেওয়ার জন্য হলেও একটা বিতর্কমুক্ত কিংবা নিদেনপক্ষে কম বিতর্ক হবে, এমন নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার নির্বাচন কমিশনার হওয়া উচিত, আর কার নয়, সেই আলোচনা অনেকটাই অর্থহীন। মজার ব্যাপার, আমরা যে কারণে এটাকে অর্থহীন বলি, সেটাই বেরিয়ে এল স্বয়ং সিইসির মুখ থেকেও। দেশে নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র নিয়ে যখন নানা মহল থেকে আওয়াজ তোলা হয়, তখন সরকারের জবাব থাকে যে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। এটাও আমরা ক্রমাগত শুনি, নির্বাচনকালীন প্রশাসন নাকি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের অধীনেই থাকে, তাই তারা করতে পারে যেকোনো কিছুই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে চারটি প্রশংসিত নির্বাচন কমিশন (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচন) কাজ করেছে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো সদ্য সাবেক নূরুল হুদা কমিশন। বাংলাদেশের ইতিহাসে চরমতম বিতর্কিত এই কমিশন তার সর্বশেষ আয়োজিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়মের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য না পাওয়াকে দায়ী করেছিল।
নিযুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পরপরই সিইসির বাসায় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হলে তিনি তাঁদের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিনিময় করেন। তাঁর বক্তব্যের কিছু অংশ এ রকম—‘জোরের সঙ্গে বলব, সব দোষ নির্বাচন কমিশনকে দিলে আমি গ্রহণ করব না। রাজনৈতিক দলগুলোর রোল আছে। পুলিশ, আনসার, র্যাবকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি ওদের কমান্ড করব না। আমি এসপিকে বদলি করতে পারব না। আমি কমান্ড করলে কেউ রাইফেল নিয়ে দৌড়াবে না।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর)
‘সবাই সুন্দর নির্বাচন চাইছে। নির্বাচন কমিশন একা নির্বাচন করে না। অনেক স্টেকহোল্ডার থাকে। নির্বাচন কমিশন টপ লেভেলে থেকে পলিসিগুলো বলে দেয়। সব সেন্টারে নির্বাচন কমিশন থাকে না। প্রশাসনকে কতটা নিরপেক্ষ করা যায়, দায়িত্বশীল করা যায়, সেটাও কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ।’ আরেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি আবারও বলেন, ‘আমার কাছে লাঠি নেই, বন্দুক নেই।’
নতুন সিইসির বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র, যেটি তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই, যদি পুরোপুরিভাবে তাঁকে সাহায্য না করে, তাহলে তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। এ দেশের নির্বাচনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন বিরোধী দল কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন রাষ্ট্রের নাগরিকেরা কি এটা কোনোভাবে বিশ্বাস করে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনিকভাবে সম্পূর্ণ সাহায্য করবে? ২০১৮ সালে প্রশাসন এবং পুলিশের সহায়তায় রাতের বেলায় ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছে যে সরকার, যে সরকার ক্ষমতার পরিবর্তন হবে না—এমন স্থানীয় নির্বাচনগুলোয়ও সব রকম অনিয়ম করেছে, সেই সরকার নির্বাচন কমিশনকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন করার জন্য সব রকম সহায়তা করবে?
নবনিযুক্ত সিইসিকে ধন্যবাদ দিতে চাই। নিজের অজান্তেই তিনি দেশে একটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রমাণ করলেন। এটা কোনো তাত্ত্বিক আলোচনার পর্যায়ে আর নেই। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, নানা রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়ে এই দেশের নাগরিকেরা জানেন, এ দেশে একটা ক্ষমতাসীন সরকার কখনো নির্বাচন কমিশনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে না। এমনকি বাংলাদেশের জন্মের পর প্রথম যে নির্বাচন, যেখানে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনেও বিরোধী দলের অতি নগণ্যসংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হতেন। সেই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও সরকার কারচুপি করেছিল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কারচুপির সেই যে সূচনা, সেখান থেকে আজও বের হতে পারিনি আমরা। বরং পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বহুগুণে। সিইসির বক্তব্যে সে বিষয়টিই আবার স্পষ্ট হলো।
● রুমিন ফারহানা বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী