মতামত

ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ নেই, কী আছে?

রাজধানীর নিউ মার্কেটে গত ১৯ এপ্রিল শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে কুরিয়ারকর্মী নাহিদ হোসেনকে কোপাতে দেখা যায়। নাহিদকে যাঁরা কুপিয়েছিলেন, পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী তাঁরা ছাত্রলীগের কর্মী।
ছবি: ডেইলি স্টারের সৌজন্যে

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) ধন্যবাদ জানাই। তারা স্বীকার করেছে, রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় যাঁরা হেলমেট পরে সহিংসতা ও হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছেন,  তাঁরা সন্ত্রাসী। তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বুধবার সাংবাদিকদের জানান, ‘আমরা তাঁদের দলীয় পরিচয় এখনই নিশ্চিত করছি না। তাঁদের দলীয় পরিচয় দেখারও বিষয় নেই। এ ছাড়া এখানে (ঢাকা কলেজ) কোনো কমিটি নেই, ছাত্রলীগ বলতে কোনো জিনিস নেই। কেউ যদি পরিচয় দিয়ে থাকে, সেটা হতে পারে। তবে আমরা এ ধরনের কিছু পাইনি। যাঁরা হেলমেট পরে মিশনে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই সন্ত্রাসী।’

এই বক্তব্য ব্যাখ্যা করলে আমরা দেখব, সন্ত্রাসীদের দলীয় পরিচয় খুঁজছে না ডিবি ( সব ক্ষেত্রে তাদের এই নীতি বজায় থাকলে রাজনৈতিক সংঘাত অনেকটাই কমে যেত)। ডিবি এখন ঢাকা কলেজে যে ছাত্রলীগ আছে, তা-ও স্বীকার করছে না। কিন্তু ডিবির যুগ্ম কমিশনার কি জানেন নিউমার্কেট এলাকায় যাঁরা সন্ত্রাস করেছেন, তাঁদের ক্ষমতার উৎস কী। হেলমেট ও ছুরি-রামদা ক্ষমতার উৎস নয়। এগুলো হলো হাতিয়ার। ক্ষমতার উৎস হলো ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ এখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা করছে, ২০০৯ সালের আগে তারা সেটি করার চিন্তাও করতে পারত না। বরং সে সময়ে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার ছিলেন। অনেক সময় আক্রান্তও হয়েছেন।

তাই, ডিবি কর্মকর্তা পুরো সত্য বলেননি। আংশিক সত্য বলেছেন। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকার অর্থ নয় যে সেখানে ছাত্রলীগ নেই। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ চার গ্রুপে বিভক্ত। বুধবার প্রথম আলোয় সহকর্মী আসিফ হাওলাদারের একটি তথ্যনির্ভর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়: ‘কমিটি থাকুক বা না থাকুক, সংঘাত আর নেতিবাচক কার্যক্রমই যেন ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের প্রধান কর্মকাণ্ড। এ কলেজে গত এক দশকে দুবার ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমবার সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় কমিটি স্থগিত হয়। দ্বিতীয়বারও সংঘর্ষের ঘটনায় কমিটির আহ্বায়কসহ ১৯ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

প্রায় এক দশক পর ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ৫৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আসাদুজ্জামান আল ফারুক নামের এক ছাত্র নিহত হন। এর পরদিনই ঢাকা কলেজ শাখার কমিটি স্থগিত এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সাত নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর নূরে আলম ভূঁইয়া ওরফে রাজুকে আহ্বায়ক করে তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এর দুই মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আহ্বায়ক নূরে আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিরণ ভূঁইয়ার অনুসারীরা সংঘর্ষে জড়ান। সংঘর্ষের সময় কলেজের ছাত্রাবাসের কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর এবং সাতটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন নেতা-কর্মীরা। ওই ঘটনায় সেদিনই আহ্বায়ক নূরে আলম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিরণ ভূঁইয়াসহ ঢাকা কলেজ কমিটির ১৯ নেতাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ কমিটি বিলুপ্ত বা স্থগিত না করা হলেও ক্যাম্পাসে ‘বিলুপ্ত কমিটি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।কমিটি বিলুপ্ত হলেও বিলুপ্ত কমিটির নেতা-কর্মীদের কার্যক্রম যে বন্ধ ছিল না নিউমার্কেট এলাকায় সাম্প্রতিক সংঘর্ষই তার প্রমাণ।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্বল নয়। তারা বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ধরেছেন। তারা জঙ্গিবাদ নির্মূল করেছেন।কিন্তু নিউমার্কেট এলাকার সংঘর্ষে জড়িত হেলমেটধারীদের ধরতে এক সপ্তাহেও ধরতে পারেনি। অথচ ঘটনার পর বিএনপির স্থানীয় কমিটির ২৪ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পরদিনই পুলিশ মামলা দিল, মকবুল হোসেন নামে এক বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নিল। মন্ত্রীরা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শোরগোল তুললেন, এই ঘটনা বিএনপির সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অংশ। তারা নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের পাকড়াও করলেন। কিন্তু যারা হেলমেট করে, চাপাতি ছুরি নিয়ে মানুষকে দিনে দুপুরে কোপাল তাদের বিষয়ে কিছুই বললেন না।

তারাও হয়তো ডিবির সুরে সুর মিলিয়ে বলবেন, সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। অতএব ছাত্রলীগের ওপর এই সংঘর্ষের দায় চাপানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত নাহিদ হোসেন হত্যায় পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই পাঁচজন হলেন মো. আবদুল কাইয়ুম, পলাশ মিয়া, মাহমুদ ইরফান, মো. ফয়সাল ইসলাম ও মো. জুনাইদ বুগদাদী। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের অভিযোগ, পুলিশ ছাত্রাবাস থেকে বের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ ফিরে এলেও সবাই ফেরেনি। আসামি ধরার নামে এই লুকোচুরির তো কোনো দরকার ছিল না।

নিউমার্কেট এলাকার সংঘর্ষে দুজন কর্মী নিহত হওয়ার পর ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করা সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররাই ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকত। সেসব ঘরে এখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কারা থাকে চিন্তা করলে গা হিম হয়ে আসে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘কিছুদিন ধরে কেন যেন মন টানছিল আমার ছাত্রজীবনের অনেক সুখ স্মৃতিজড়িত ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেল একবার ঘুরে আসব। কলেজে পড়ার দুই বছর ১৯৬৩-৬৫ সালে হোস্টেলের যে ঘরটিতে একটানা থেকেছিলাম, দোতলার সেই ২১৬ নম্বর ঘরটিতে এখন কারা থাকে, কীভাবে থাকে, জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ভেবেছিলাম তাঁদের সঙ্গে বসে একটু স্মৃতিচারণা করে আসব। কিন্তু তা বোধ হয় আর হলো না।’

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাম্প্রতিক সময়ের সহিংস ঘটনার কথা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘কজন নিরীহ পথচারী কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার ছবি দিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন বেরিয়েছে। জীবজগতের মধ্যে মানুষই যে সবচেয়ে নৃশংস হতে পারে, এই জানা কথাটা নিজের চেনাজানা পরিবেশের মধ্যে নতুন করে ঘটতে দেখলে মনে ধাক্কা লাগে। বিশেষ করে, যখন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।’

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ঢাকা কলেজের যেই ছাত্রাবাসে তিনি ছিলেন, সেখানে এখন কারা থাকে, তা চিন্তা করলে গা হিম হয়ে আসে। এই অনুভূতি কেবল তার একার নয়, ঢাকা কলেজের প্রায় সব প্রাক্তন ছাত্রের। তিনি সাহস করে নিজের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। অন্যরা সেটিও পারছেন না। এটা কীসের আলামত?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

ই–মেইল: sohrabhassan55@gmail.com