সকালে পত্রিকার পাতা খুললেই সড়কে মৃত্যুর খবর। রাজধানীতে বছরে তিন শতাধিক মৃত্যু। জনকণ্ঠ পত্রিকার একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ২০০৬ সালের এপ্রিলে বাংলামোটরের জেব্রা ক্রসিংয়ে মারা যাওয়ার খবরে আঁতকে উঠেছিলাম। কারণ, তখন রাজধানীতে এমন মৃত্যু ছিল বিরল। এক যুগ পর সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ১৯ মার্চ সকালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী সড়কের জেব্রা ক্রসিংয়ে ‘সুপ্রভাত’ বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। গত বছর জুলাই মাসে এয়ারপোর্ট রোডে ‘জাবালে নূর’–এর বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা যান। তারপর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক চেয়ে ব্যাপক আন্দোলন করার পরও সড়কের অব্যবস্থাপনা বা পথচারীদের রাস্তা পারাপারে উন্নতি হয়নি। ইতিমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে কয়েকবার ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হলেও অবস্থার উন্নতি লক্ষ করা যায় না।
এখনো মেট্রোরেলের মতো কোনো গণপরিবহন না থাকায় ঢাকাবাসী বাস ও রিকশার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। মেট্রোরেল–পাতালরেলের শহরেও বাস সার্ভিস থাকতে হয়। ঢাকার মতো বাস সার্ভিসের অব্যবস্থা পৃথিবীর কোনো শহরে আছে বলে জানা নেই। চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করলেও জাবালে নূরের ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে যা দেখাল, তারপরও সেই চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা তো বন্ধ হয়নি। কারণ, এভাবে এই সমস্যার সমাধান হয় না, যেহেতু ‘সুপ্রভাত’ নাম পাল্টে ‘সম্রাট’ করা এক রাতের ব্যাপার, ঢাকার বর্তমানের পুরো বাস সার্ভিসের খোলনলচে পাল্টে ফেলা দরকার। এ জন্য ২২ এপ্রিল ২০১৬ প্রথম আলোয় ‘গতিশীল বাস সার্ভিস ও ঢাকার যানজট’ শিরোনামে লিখেছিলাম।
ঢাকায় গতিশীল বাস সার্ভিস চালু করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ঢাকায় ছয়টি কোম্পানির আওতায় ছয় রঙের বাস চালু করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর দায়িত্বটি ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পেয়েছেন বলে পত্রিকায় পড়েছি। ব্যক্তিবিশেষের নয়, কোম্পানির আওতায় বাস চলবে। বর্তমানের সব বাস ভর্তুকি দিয়ে হলেও রাস্তা থেকে তুলে দিতে হবে। তবে একটি নীতিমালার মধ্য দিয়ে বর্তমানের বাসমালিকেরা নতুন বাসের শেয়ারের মালিক হবেন। তাঁদের সমস্যাটার গুরুত্ব বুঝতে হবে। তাঁদের প্রিয়জনদেরও রাস্তায় চলতে হয়। ছোট যানবাহন, প্রাইভেট কার চালানো নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাস খুব ভালো মানের শতভাগ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
রাজধানীবাসী বর্তমানে যে হারে রিকশাভাড়া বহন করে চলছে, তাতে এমন লাক্সারি বাসভাড়া কস্ট-ইফেক্টিভ হবে। বেইজিংয়ের মতো সারা ঢাকা শহরে একটি ভাড়া (যেমন ৩০ টাকা) গতিশীল ব্যবস্থাপনার জন্য অপরিহার্য। কম দামি সস্তা বাস নামালে এই পরিকল্পনা যে কাজ দেবে না, তা আগে থেকেই বলা যায়। সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, পেনাং, বেইজিং গিয়ে বাস সার্ভিসের পরিকল্পনা ও বাসের মান দেখে আসা ভালো। বাসগুলো মার্সিডিজ বেঞ্জ, ভলভো ও স্ক্যানিয়া কোম্পানির। এমন বাস হলে উচ্চবিত্তরাও বাসে চলবেন। তা ছাড়া একটি গাড়ি মেইনটেন করা অতিশয় ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।
এখনকার বাস পাল্টে উন্নত মানের নতুন বাস নামানো যেমন জরুরি, তার চেয়ে কম জরুরি নয় বাসগুলো যাঁরা চালাবেন, তাঁদের দক্ষতা। ওস্তাদের কাছে শিখে স্টিয়ারিং ধরা বন্ধ করতে হবে। যার প্রিয়জন চলে যায়, সে বোঝে মর্ম। একজন চালকের জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ কারণ, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাও মারা যান বা পঙ্গুত্ব বরণ করেন। পরিবারে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। তাই যোগ্যতা শুধু স্টিয়ারিং ধরে চালানোর না হয়ে মানবিক আচরণের দিকও দেখতে হবে। এ বিষয়ে বিআরটিএকে ঢেলে সাজানো জরুরি। চালকদের প্রশিক্ষণ আর যাচাই–বাছাইয়ের কাজে অন্তত ২০ বিঘা নিয়ে একটি এরিয়া বিআরটিএর থাকা দরকার। চালকদের গাড়ি চালানোর আর সহনশীলতার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পারে দেশের বর্তমান সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে। যেমন চালকদের লাইসেন্স দেওয়াটা গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনির মতো হওয়া দরকার। ড্রাইভিংয়ের দক্ষতায় যেমন ঘাটতি না থাকে, তেমনি মানবিক গুণাবলিরও পরীক্ষা হওয়া দরকার। সব পরীক্ষায় পাস করার পর লাইসেন্স পাওয়ার আগে চালকেরা একসঙ্গে দাঁড়ানো অবস্থায় ডান হাত বুকের বাঁ পাশে রেখে জাতীয় সংগীত গেয়ে শুরু করবেন এবং শপথবাক্য পাঠ করে শেষ করবেন।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাই নতুন অনেক কিছু এই দেশে হচ্ছে ও হবে যা এর আগে ছিল না। যেমন বর্তমানে নির্মাণাধীন মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেল। অদূর ভবিষ্যতে হবে পাতালরেলসহ আরও অনেক কিছু। নগদে রাজধানীতে গতিশীল বাস সার্ভিস দরকার। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য ইতিমধ্যে দুবার অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে, সুফল মেলেনি। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ও গতিশীল বাস সার্ভিসের ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি এ দেশে নতুন। এর জন্য বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বা এনআরবি (নন–রেসিডেন্ট বাংলাদেশি) অনেকে মাতৃভূমির টানে দেশের জন্য কিছু করতে চান। তাঁরা খুব একটা পারিশ্রমিকও আশা করেন না। যাঁর যেটার ওপর বিশেষ দক্ষতা আছে, তাঁর সে দক্ষতা দেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজে লাগানো দরকার। বহু বাংলাদেশি মেধাবী প্রকৌশলী উন্নত বিশ্বে থেকে সারা জীবন কাজ করার ক্ষেত্র পেয়েছেন। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং অনেকেই অবসর জীবন যাপন করছেন। যেসব বাংলাদেশি প্রকৌশলী সারা জীবন দেশের মধ্যেই কাজ করেছেন, তাঁদের সুযোগ হয়নি বাংলাদেশে এ পর্যন্ত না হওয়ার মতো প্রজেক্টে কাজ করার। চীন তাদের জনবলকে বিদেশ পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফিরিয়ে এনে দেশ গড়ায় কাজে লাগিয়েছে। একসময় জাপানও আমেরিকা ও ইউরোপে জাপানিদের পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ বিদেশে থাকা তার সন অব সয়েলদের বেশি বেশি কাজে লাগানো জরুরি।
ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ