এখন খরাকাল। ‘প্রখর, দারুণ, অতি দীর্ঘ–দগ্ধ দিন’ চোখ রাঙায়। পথের দুপাশে ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে হেঁটে চলে মানুষ, ভ্রুক্ষেপহীন। সড়কে প্রায় স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাস-গাড়িকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে ছুটে চলে সবাই। ছোটে বললেও ভুল হবে কিছুটা। পুরোপুরি ছুটতে পারে না, টক্কর লাগে, মানুষের সঙ্গে মানুষের, ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা দোকানের সঙ্গে মানুষের; আরও কত–কীর সঙ্গে যে টক্কর লাগে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ঝাঁজালো রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে থাকা এই মানুষেরা এসব টক্করে অভ্যস্ত হলেও মাঝেমধ্যেই খেপে ওঠে, জড়িয়ে পড়ে বিতণ্ডায়।
রাজধানী ঢাকার ফুটপাত এক দারুণ জিনিস। এখানে কিসের দেখা মেলে না! সর্বরোগের মহৌষধ হিসেবে আশ্চর্য বটিকা থেকে শুরু করে ‘এনার্জি লাইট ১০০ টাকা’, বিচ্ছু মলম থেকে শুরু করে আধুনিক গেজেট—সবকিছুরই দেখা মেলে এই ফুটপাতে। আছে ভেঙে যাওয়া সার্কাস দলের সদস্যরা; নানান খেলা দেখায় তারা। আছে আরও নানা রঙের, নানা ধরনের মানুষ। কেউ বসে থাকছে, কেউ যানজটে আটকা পড়া বাস-গাড়িতে বিক্রির জন্য নানা পসরা হাতে নিয়ে ঘুরছে। এই পসরায় রয়েছে রান্নাঘরের জরুরি সরঞ্জাম থেকে শুরু করে চাটনি, রুমালসহ বিচিত্র সব সামগ্রী। থাকে ভিক্ষুকের দল। এসব জটলা ডিঙিয়ে প্রতিদিন স্থিরচিত্রের মতো মূল সড়কের পাশের এই হাঁটাপথ ধরে ছুটে চলে আদতেই ব্যস্ত মানুষেরা। অবশ্য নানা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের কারণে কিছু সড়কের পাশের ফুটপাতটি বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে কোনো প্রতিস্থাপন ছাড়াই। সে কথা তোলা থাক।
এই ফুটপাতকে মানুষের চলাচলের জন্য মুক্ত করতে বহু কথা বলেছেন বিশিষ্ট-অবিশিষ্টজনেরা। এসব বিষয় নিয়ে যখন ভীষণ কথা হয়, তখন প্রশাসনকে দেখা যায় চটজলদি ফুটপাতের ব্যবসায়ী উচ্ছেদে নেমে যেতে। কিন্তু এ জন্য আদৌ কোনো পরিকল্পনা করা হয় না। এ কারণে এই অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের সংকটটি বারবার সামনে আসে। আসে মানবিক দিক বিবেচনার আহ্বান। কিন্তু সেই আহ্বানে কখনোই আশ্বাস ছাড়া প্রশাসনকে আর কোনোভাবে সাড়া দিতে দেখা যায় না। ফলে, সংকট ও সমাধানের পুনঃ পুনঃ মঞ্চায়ন দেখা যায়। এতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে নাগরিকেরা।
ফুটপাতে মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে এতে থাকা ‘অবৈধ’ দোকানগুলো নিয়ে বেশ কথা হয়। অবৈধ শব্দটিকে ঊর্ধ্বকমার ভেতরে রাখার কারণ হচ্ছে, এই অবৈধ তকমা পাওয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বৈধ-অবৈধ কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই টিকে থাকেন। ফলে, তাদের অবৈধ বলতে হলে ঊর্ধ্বকমায় রেখেই বলতে হয়। সে যা হোক, এই ‘অবৈধ’ দোকানগুলো নিয়ে এত কথা হয় যে ফুটপাতের আরেক উৎপাত মোটরসাইকেল একরকম চাপাই পড়ে যায়। তবে বিষয়টি নিয়ে সেভাবে আলোচনা না হলেও নগর কর্তৃপক্ষ নিশ্চিতভাবেই তা লক্ষ করেছে। এ কারণে ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাতে লম্বা লম্বা লোহার কাঠামো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের ফুটপাতে এই লোহার গেটগুলো রয়েছে। এই লোহার কাঠামোগুলো এমনভাবে বসানো, যাতে কোনো মোটরসাইকেল এদিক দিয়ে না যেতে পারে। নগর কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এগুলো বসানো হয়েছে। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এ কাঠামোর বিষয়ে নগর কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, সেহেতু এতে তাদের সম্মতি রয়েছে বলেই মনে হয়।
ঢাকার ফুটপাতে বিদ্যমান অগণিত উৎপাতের মধ্যে এই লোহার কাঠামোগুলো নতুন উৎপাত হিসেবে যুক্ত হয়েছে। কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ফুটপাতে আগে যে সজ্জায় এ কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত (এখনো দাঁড়িয়ে), তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন ও চরম উদ্ভাবনী সজ্জা দেখা গেল সম্প্রতি শাহবাগে শিশুপার্কের সামনের ফুটপাতে। এমনভাবে লোহার কাঠামোগুলো সজ্জিত করা যে সেখানে ভিড় লেগে যায়। মানুষ ধন্দে পড়ে যায়, কীভাবে এই গোলকধাঁধা পার হবে ভেবে। এ এক নতুন হুজ্জত, যার জন্ম হয়েছে ফুটপাতে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য কমাতে। ইদানীং অ্যাপভিত্তিক পরিবহনসেবা জনপ্রিয় হওয়ায় এবং মোটরসাইকেল সেবার জনপ্রিয়তা অতিমাত্রায় বাড়ায় এই দৌরাত্ম্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আর এই দৌরাত্ম্য থামাতে এখন মানুষকেই বন্দী করা হচ্ছে। ঢাকার যানজটে জেরবার হয়ে যে মানুষেরা ফুটপাতে নেমে আসছে, তাদের গতি রোধ করেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই কাঠামোগুলো। এই পদক্ষেপকে অনেকটা সিএনজিচালিত অটোরিকশার রূপান্তরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যখন সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রা হলো, তখন দেখা গেল, এর খোলা দরজাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। আর ছিনতাই থেকে বাঁচতে মানুষের জন্য একটি চলমান কারাগারের বিকল্প হাজির হলো। এখন যানজটে আটকে থাকা সিএনজিচালিত অটোরিকশার ছাদ কেটে ছিনতাই হচ্ছে, ছিনতাই বলতে মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া। এরও সমাধান এসেছে—বাহনটির প্লাস্টিকের ছাদের তলায় লোহার ছানি বসিয়ে। অর্থাৎ নগরবাসী ক্রমাগত কারাগারে সেঁধিয়ে পড়বে, এটাই নাগরিক সব যন্ত্রণার একমাত্র সমাধান!
ঢাকার ফুটপাত এমনিতেই মানুষের চলাচলের জন্য উপযোগী নয়। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকেই এই পথে চলতে অনেক কসরত করতে হয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য তো এ পথে চলাটা একেবারে অসম্ভব। আর এখন যে কাঠামোগুলো দাঁড়াচ্ছে শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে, তাতে করে কিছুটা স্থূলদেহী, কিংবা সঙ্গে মালামাল রয়েছে, এমন মানুষের পক্ষেও এ পথে চলাটা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বলা হয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের আর যোগ নেই তেমন। মানুষ অসহনশীল হয়ে উঠছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে না। এমন বহু অভিযোগ রয়েছে দেশের মানুষের সম্পর্কে। কথা হচ্ছে, শুধু পথ চলতে গিয়েই যদি সব শক্তি ও মেধার প্রয়োগ ঘটাতে হয়, নিজের পথচলা নিয়েই যদি নিরন্তর ভেবে চলতে হয়, তবে সে অন্য কিছু নিয়ে কখন ভাববে? এই শহরে মানুষ হাঁটে নিচের দিকে তাকিয়ে, কারণ তাকে খানাখন্দ বাঁচিয়ে চলতে হয়। যে মানুষ প্রাত্যহিক পথ চলতেই নতমুখ থাকতে বাধ্য হয়, সে কী করে জীবনের দীর্ঘ পথে মাথা উঁচু করে, বুক চিতিয়ে সোচ্চার হয়ে দাঁড়াবে? যে শহরের বাতাসে বিষ (বায়ুদূষণের কারণে অপরাধ প্রবণতা ও অসহনশীলতা বাড়ে বলে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের এক গবেষণায় উঠে এসেছে সম্প্রতি), যে শহরের পথে শব্দের উৎকট সন্ত্রাস (উচ্চ শব্দের পরিবেশে বেশি সময় থাকলে বাড়ে অস্থিরতা, মেজাজ হয় খিটখিটে), যে শহরের গলি-ঘুপচিতে ওত পেতে থাকে আততায়ী, যে শহরে যানবাহনগুলো চলে একনায়কের মতো ভ্রুক্ষেপহীন মানুষকে পিষে দিয়ে, সে শহরে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে কী করে পারবে? এক কথায় বলা যায়, ঢাকার সড়কই নিস্পৃহ মানুষের নির্মাতা। আর যখন সবার নজরে থাকা খোদ রাজধানীর অবস্থা এমন হয়, তখন দেশের অন্য অঞ্চলের কথা না বললেও চলে।
এই সড়কগুলোই যেন ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই যন্তর-মন্তর, যেখানে রাজার আদেশে মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আনুগত্যের বাণী। ‘লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে’র মতো এখানে ‘অন্য নিয়ে ভাবে যে, অপঘাতে মরে সে’ শেখানো হয় হামেশা। না, কোনো উচ্চারণে নয়, পুরো ব্যবস্থাই এখানে বিনা উচ্চারণে এই ‘মহাবাণী’ শিখিয়ে চলেছে। মানুষ আর কোনো দিকে তাকাচ্ছে না, ভাবছে না। ভাবনারহিত পথ চলতে গিয়ে মানুষ এক স্বার্থপর, নির্মম যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে, যা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব দুর্নীতি ও একচেটিয়াপনাকে চলতে দিতে সহায়তা করছে। আর এই বাস্তবতাই হত্যা-ধর্ষণ ও অজস্র অপরাধের এ বিপুল ফলনের সময়ে প্রতিবাদী মানুষের ক্ষরাকাল নিয়ে হাজির হচ্ছে। কোনো ঘটনা হঠাৎ প্রচার পেলে এই মানুষেরা ক্ষণিকের জন্য জেগে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। তার পক্ষে বেশিক্ষণ জেগে থাকাটাই যে সম্ভব নয়।