মতামত

ঢাকার জনঘনত্ব ও ইমারত আইনের বাস্তবতা

সম্প্রতি ঢাকার খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গণশুনানির জন্য উন্মুক্ত হলে ঢাকার জনঘনত্ব পরিকল্পনার বিষয়টি আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসে। এর আগে বাংলাদেশের নগর-পরিকল্পনায় জনঘনত্ব বিষয়টির উল্লেখ থাকলেও পরিকল্পনার কৌশল হিসেবে তার প্রয়োগ সীমিত পরিসরে দেখা গিয়েছে। পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নির্ধারণ করা না গেলে যেকোনো শহর বাসযোগ্যতা হারাতে বাধ্য, ঢাকা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । এবারের ড্যাপে শহরের এলাকাভিত্তিক ধারণক্ষমতা, অবকাঠামো ও অন্যান্য নাগরিক সেবার সঙ্গে জনসংখ্যা ও জনঘনত্বকে পরিকল্পনার যোগসূত্র হিসাবকে বিবেচনা করা হয়েছে, যা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এবারই প্রথম ঢাকা মহানগরের রাজউকের আওতাধীন সমগ্র এলাকার জন্য জনঘনত্ব পরিকল্পনার কৌশল হিসেবে পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণ ও এলাকাভিত্তিক ভারবহন ক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকার জন্য ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার এ প্রস্তাবনার গভীরে যেতে হলে এ-সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান ও আগের ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আলোচনা প্রাসঙ্গিকভাবেই গুরুত্ব বহন করে।

২.

ঢাকা শহরের ভবনের উচ্চতা নির্ণয়ে ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী প্লটসংলগ্ন বিদ্যমান রাস্তার প্রশস্ততাকেই মূল ভিত্তি ধরা হতো। ভবনের উচ্চতা ‘রাস্তার প্রশস্ততা এবং ভবন ও রাস্তার মধ্যবর্তী উন্মুক্ত স্থানের যোগফলের দুই গুণ’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হতো। ফলে, এই বিধিমালা অনুযায়ী নগরের রাস্তার প্রশস্ততার ভিন্নতা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকার জন্য বিভিন্ন উচ্চতার ভবন পরিলক্ষিত হতো, যদিও এই বিধিমালায় নগর এলাকার অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধাদি প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে জনঘনত্ব পরিকল্পনার কোনো কৌশল সরাসরি অনুসরণ করা হয়নি। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে ভবনের উচ্চতা, আকার ও আয়তন নির্ধারণ হয়ে থাকে এবং সারা দেশের অন্যান্য নগর এলাকায় ইমারত নির্মাণের জন্য ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬’ অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

সাধারণ বিবেচনায় বসত এলাকার রাস্তার প্রশস্ততা মানুষের চলাচল ও যানবাহনের যোগাযোগ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ধারণক্ষমতার পরিমাপক হিসেবে কাজ করে এবং উন্মুক্ত স্থান হিসেবে রাস্তার প্রশস্ততা সড়ক-সংশ্লিষ্ট ভবনগুলোর আলো-বাতাসের প্রবেশকে প্রভাবিত করে। পাশাপাশি নগর-পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্লটের ওপর নির্মিত ভবনের আকার-আয়তন কেমন হওয়া উচিত, তা শুধু প্লটসংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততার ওপর নির্ভর করে না। এ ক্ষেত্রে সেই নগর এলাকার পরিকল্পনা-সম্পর্কিত অবকাঠামো ও নাগরিক সুযোগ সুবিধাদি, যেমন: সড়ক অবকাঠামো, পরিষেবা অবকাঠামো, সামাজিক সুবিধাদি যথা স্কুল, হাসপাতাল, বাজার প্রভৃতি; উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান, জলাশয় ও জলাধার; নগর এলাকার প্রকৃতি প্রভৃতি সম্যক বিবেচনায় নিয়ে সেই এলাকার ভারবহন ক্ষমতা নির্ণয় সাপেক্ষে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা নির্ধারণ করার মাধ্যমে জনঘনত্ব নির্ধারণ করে প্রতি প্লটে কী পরিমাণ পরিবার বা মানুষকে ধারণ করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে পরিকল্পনার কৌশল ও পন্থা নির্ধারণ করা হয়।

৩.

বৈশ্বিক পরিকল্পনার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, নগর-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ছোট আয়তনের প্লটে ভবন নির্মাণ তথা উন্নয়ন অধিকার (ডেভেলপমেন্ট রাইট) এবং ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল একই রকম হয় না। এই ভিন্নতা অনুধাবন করতে না পারার কারণেই ঢাকা শহরের বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সঠিক কৌশল নির্ধারণ করতে পারেনি। একই সঙ্গে বর্তমান ঢাকার খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় এই ক্ষুদ্র প্লটভিত্তিক ভবনের ওপর ভবনের উচ্চতা-সম্পর্কিত প্রস্তাবনা বৈশ্বিক নগর-পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতে গিয়ে অনেকেই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন, যে হিসাবের সঙ্গে নগর এলাকার ধারণক্ষমতা, বাসযোগ্যতা ও বৃহত্তর জনকল্যাণ ও জনস্বার্থের ধারণা অনুপস্থিত।

ঢাকা শহরের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬-এ প্লটসংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততাকে ভিত্তি ধরে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করে ২০০৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর বা ‘ফার’) কৌশল প্রস্তাবনা করা হয়েছে, যাতে সমগ্র রাজউক এলাকার ১৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য শহরের এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক ভিন্নতাকে বিবেচনায় না নিয়ে সর্বজনীন ‘এফএআর’ মান প্রয়োগ করা হয়েছে। এফএআর হচ্ছে কোনো একটি প্লট বা জমির আয়তনের বিপরীতে নির্মিত ইমারতের সব ফ্লোর বা তলায় সর্বমোট কত আয়তনের ভবন নির্মাণ করা যায়, তার সূচক। উদাহরণস্বরূপ এফএআর মান ৫ হলে ভবনের ভূমি আচ্ছাদন (বিল্ডিং কাভারেজ) যদি ৫০ শতাংশ হয়, সে ক্ষেত্রে প্লটে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে।

৪.

ইমারত বিধিমালায় এই এফএআর কৌশল নির্ধারণ করার সময় আমরা মোটাদাগে চারটি বিষয় বিবেচনা করতে সক্ষম হইনি—প্রথমত, আমাদের শহর এলাকায় প্লটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকার ও আয়তন, দ্বিতীয়ত পরিকল্পনার মানদণ্ডে এফএআরের অতি উচ্চ মান; তৃতীয়ত সমগ্র রাজউক আওতাধীন ঢাকার নগর এলাকার জন্য এফএআরের একই মান এবং চতুর্থত এফএআর কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কঠোর নজরদারি করার সক্ষমতার অভাব। ফলে, বাস্তবে এফএআর কৌশলের অপপ্রয়োগ হতে দেখা গেছে ঢাকা শহরের সর্বত্র।

২০০৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় উল্লেখ ছিল, ‘এফএআরের সর্বোচ্চ মান নির্ধারণ করা হয়েছে ঘনবসতি এলাকার জন্য। ব্যবহারের ধরন সাপেক্ষে পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ দ্বারা নগরীর প্রান্ত এলাকায় এবং অন্যান্য শহরে এই মান নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন করা যেতে পারে।’ অথচ এই এলাকাভিত্তিক এফএআর মান তৈরি না করে পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় এফএআর মান কাদের স্বার্থে আরও বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। একই সঙ্গে এফএআর এই মান প্রয়োগের ফলে নগর এলাকায় পরিকল্পনাগত কী ধরনের প্রভাব পড়বে, এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কী দাঁড়াবে, তার কোনো ধরনের বিশ্লেষণ না করেই এই বিধিমালা প্রস্তুত করা হয়েছিল। একই সঙ্গে ২০১৬ সালে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে বিশদ আলোচনার জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে, সেখানেও এলাকাভিত্তিক এফএআর মান তৈরি করা হয়নি।

৫.

২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় আবাসিক ভবনের জন্য মোটাদাগে রাস্তার প্রশস্ততা ও প্লটের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন এফএআর মান ৩ দশমিক ১৫ ও সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য শহরের এফএআর মান আলোচনা করলে আমরা ঢাকা শহরের জন্য এই মানের উপযোগিতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় প্রতিবেশী ভারতের শহরগুলোর উদাহরণ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় নগর এলাকায় যেখানে জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ লাখ বা প্রতি একরে ৪০০ জন, সেখানে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা চেন্নাইয়ের কেন্দ্রীয় নগর এলাকায় জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ হাজার বা প্রতি একরে ১০০ জন। চেন্নাই শহরের এফএআর মান ১ দশমিক ৫ এবং ১০ কাঠা পর্যন্ত প্লটের ক্ষেত্রে পাঁচতলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যায়। চেন্নাই শহরের ক্ষেত্রে উন্নয়ন স্বত্ব কিনে (উন্নয়ন স্বত্ব কৌশল এবারের ড্যাপেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে) এফএআর বোনাস পাওয়া, সে ক্ষেত্রে এফএআর মান সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ পর্যন্ত হতে পারে।

দিল্লি শহরের ইমারত আইন অনুযায়ী এফএআর মান সর্বনিম্ন ২ ও সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫ এবং প্লটভিত্তিক ভবন নির্মাণ করা হলে ইমারতের সর্বোচ্চ উচ্চতা ১৫ মিটার, যা পাঁচতলা পর্যন্ত হতে পারে। ভারতের অন্যতম বড় শহর বেঙ্গালুরুর আবাসিক এলাকার এফএআর মান সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৭৫ ও সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২৫ এবং ৩০ ফুট পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্ততা হলে সেখানে চারতলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যায়।

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ঢাকা শহরের আবাসিক ভবনের জন্য এলাকাভিত্তিক ভারবহন ক্ষমতা ও নাগরিক সুবিধাদির বিপরীতে ভবনের উচ্চতার জন্য যে পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে, তা ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বর্তমান কারিগরি সক্ষমতা বাড়াতে হবে, মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে।

৬.

ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের মাধ্যমে নগর এলাকার জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নির্ধারণ নগর-পরিকল্পনায় একটি প্রতিষ্ঠিত কৌশল এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নগর-পরিকল্পনায় এর প্রয়োগ দেখা যায়। বিশেষত, নগর কর্তৃপক্ষগুলোর নজরদারির সক্ষমতা ও সুশাসনের ঘাটতি থাকলে এই কৌশল সবচেয়ে কার্যকর। ঢাকা শহর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে উচ্চতাভিত্তিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে পরিকল্পিত এলাকা ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী প্রভৃতি এলাকায় ছয়তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমোদনের মাধ্যমে এলাকাগুলোয় জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল; পরবর্তীতে উচ্চ এফএআর মান প্রয়োগের কারণে এসব এলাকায় জনঘনত্ব বেড়ে গিয়েছে।

আমরা অনেকেই উঁচু আবাসিক ভবন নির্মাণকে উৎসাহিত করতে গিয়ে সিঙ্গাপুর শহরের উদাহরণ উল্লেখ করি, যদিও সিঙ্গাপুর শহরের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক আর্থসামাজিক-পরিকল্পনাগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্র নয় এবং আমাদের রাজধানী ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চল রয়েছে, যেখানে উন্নয়ন করার মতো অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সিঙ্গাপুর শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ জমি সরকারের মালিকানাধীন, যেখানে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব আর ঢাকা শহরের ভূমি মালিকানা প্রধানত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লট মালিকানানির্ভর, যেখানে ব্যক্তি উদ্যোগে ভবন নির্মিত হয়। তৃতীয়ত, সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় যেখানে ৬০ হাজার ডলার, সেখানে আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ২ হাজার ডলার হওয়ায় আমাদের রাষ্ট্র ও মানুষের অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগত সক্ষমতা অনেক কম। তা সত্ত্বেও যদি আমরা সিঙ্গাপুর শহরের ইমারত-সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান দেখি, সেখানে ১২ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবনের উচ্চতার জন্য এফএআর মান ১ দশমিক ৬ এবং ২৪ তলা পর্যন্ত এফএআর মান ২ দশমিক ১। সিঙ্গাপুর শহরে ছোট আয়তনের জমিতে বহুতল ফ্ল্যাট বানানো যায় না; ফ্ল্যাট বানাতে হলে ভূমির আয়তন হতে হয় প্রায় এক বিঘা এবং ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে নাগরিক সুবিধাসংবলিত কনডোমিনিয়াম বানাতে গেলে জমির পরিমাণ হতে হয় এক একর। উদাহরণস্বরূপ সিঙ্গাপুর শহরে ব্যক্তিমালিকানাধীন পাঁচ কাঠা জমিতে ভবন নির্মাণ করতে গেলে একক বা দুই পরিবারের আবাসিক ইউনিট বানানোর অনুমোদন আছে, যা সাধারণত এক-দ্বিতলবিশিষ্ট ভবন হবে; বৈশ্বিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাধারণত ছোট আয়তনের জমিতে ব্যক্তি উদ্যোগের ভবন নির্মাণে এই উদাহরণই অনুসরণ করা হয়। অথচ ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে তিন থেকে চার কাঠা জমির ওপরে আমরা প্রত্যেকেই মুনাফা লাভের জন্য ৮ থেকে ১০ তলা ভবন নির্মাণে আগ্রহী। আমাদের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নজরদারির সক্ষমতা না থাকায় ভবনের অনুমোদিত প্ল্যানে ৫০ শতাংশ ভূমি আচ্ছাদন দেখিয়ে বেশি এফএআর মানের সুবিধা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভূমি আচ্ছাদন নির্মাণের মাধ্যমে শহরের আবাসিক ভবনের ভেতর আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা আমরা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছি। এ কারণে ঢাকা শহরের অপ্রতুল অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদির বিপরীতে বিভিন্ন এলাকায় জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলছে এবং উঁচু ভবন নির্মাণের কারণে আবাসিক ভবনের ভেতর সূর্যের আলো, বায়ুপ্রবাহের অপর্যাপ্ততার কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, তথা সার্বিক জনস্বাস্থ্য প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন।

৭.

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ঢাকা শহরের আবাসিক ভবনের জন্য এলাকাভিত্তিক ভারবহন ক্ষমতা ও নাগরিক সুবিধাদির বিপরীতে ভবনের উচ্চতার জন্য যে পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে, তা ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বর্তমান কারিগরি সক্ষমতা বাড়াতে হবে, মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ড্যাপ প্রণয়নের লক্ষ্যে জনঘনত্ব পরিকল্পনার কার্যপত্রে (ওয়ার্কিং পেপার) ভবনের উচ্চতার নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি প্লটে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা (ডুয়েলিং ইউনিট) নির্ধারণের যে প্রস্তাবনাগুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে, তা ড্যাপের খসড়া প্রতিবেদনে অনুপস্থিত থাকলেও চূড়ান্ত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সংযোজন করা উচিত। ভবনের উচ্চতা প্রস্তাবনার সঙ্গে প্রতি প্লটে পরিবারের সংখ্যা নির্ধারণ ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি খসড়া ড্যাপে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ডুয়েলিং ইউনিট সংখ্যা নির্ধারণ করে জনঘনত্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত, না হলে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা অকার্যকর হবে।

৮.

নগর-পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা প্লটভিত্তিক উন্নয়ন অধিকার ভাবনার চেয়েও বিস্তৃত পরিসরের বিষয়, যা রাষ্ট্র ও পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষগুলোকে বৃহৎ আঙ্গিকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে টেকসই ও কার্যকর নগর তৈরি করতে অন্যান্য অবকাঠামো, সুবিধা ও পরিষেবাসংক্রান্ত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হয়। যেকোনো নগর-পরিকল্পনার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে রেখে শহর তৈরি করা। খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার জনঘনত্ব পরিকল্পনাকে পরিশীলিত করে চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্য নগর এলাকার পরিকল্পনায় জনঘনত্বের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অনুশীলন করা উচিত। বসবাসযোগ্যতার বিচারে ঢাকা ধারাবাহিকভাবে তলানির দিকেই অবস্থান করছে এবং অন্য নগর এলাকাগুলোও এ ক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। দেশের রাজধানী হিসেবে বাসযোগ্যতা বাড়াতে ঢাকাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে এবং ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে দেশের অন্য নগর এলাকাগুলোও নিশ্চয়ই ঢাকার পথ অনুসরণ করে ঘুরে দাঁড়াবে।

ড. আদিল মুহাম্মদ খান নগর-পরিকল্পনাবিদ এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

adilmdkhan@gmail.com