অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর কল্যাণে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ভার্চ্যুয়াল মার্কেটপ্লেস, ফলে বাস্তব আর ডিজিটাল অর্থনীতির মধ্যে তৈরি হয়েছে ফারাক। করোনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি লোককে এখন পণ্য, পরিষেবা ও কাজের খোঁজে অনলাইনের দিকে চালিত করছে। ফলে ফারাকটা আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তিই এমন যে আজকের অর্থনীতিতে পরিমাপযোগ্য ও অপরিমাপযোগ্য উপাদানগুলো সহাবস্থান করতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে উৎপাদনমুখী নতুন সমন্বয়। অর্থনীতির পরিমাপযোগ্য দিকটি জোগায় অবকাঠামো, আর অপরিমাপযোগ্য দিক এ প্রক্রিয়াগুলোকে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে।
অপরিমাপযোগ্য অর্থনীতির একটি পূর্বশর্তই হচ্ছে পরিমাপযোগ্য অর্থনীতি। ডিজিটালায়নের মাধ্যমে পরিমাপযোগ্যই হয়ে উঠতে পারে অপরিমাপযোগ্য, অতিক্রম করতে পারে মাপকাঠি আর মানের গতানুগতিক সীমাবদ্ধতা। ভীষণ রকম লেনদেনকেন্দ্রিক এবং মূলধননিবিড় হওয়ায় প্রবৃদ্ধির জন্য প্রক্রিয়াটি এখন পর্যন্ত ইতিবাচক, ছোট-বড় সব ধরনের দেশের জন্যই কিছুটা সমসুযোগ সৃষ্টি করেছে।
তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ আদর্শ বর্ণনা অর্থনীতির ডিজিটাল আর প্রকৃত খাতের মধ্যে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিচ্ছেদকে উপেক্ষা করেছে। উৎপাদনের গতানুগতিক উপাদান বাদ দিয়ে লাভবান হওয়া সংস্থাগুলো কোভিড-১৯-এর আগে যে গতিতে বাড়ছিল, এখন বাড়ছে তার চেয়েও দ্রুত।
মহামারিতে ফেসবুক, আমাজন ও অ্যাপলের শেয়ারের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। দুই ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যমানে পৌঁছা প্রথম কোম্পানি হয়ে ওঠে অ্যাপল। নেটফ্লিক্স ও অ্যালফাবেটের (গুগল) শেয়ার দ্বিগুণ না হলেও সর্বকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায় বা তার কাছাকাছি ব্যবসা করছে তারা। অন্যদিকে, অ্যাপলের স্টক ভাগ করে ফেলার সিদ্ধান্তে সূচক থেকে ছিটকে পড়েছে অ্যাক্সনমোবিল, এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর মতো প্রবীণ সদস্য এবং পরিমাপযোগ্য অর্থনীতির সাবেক আইকন। টেক জায়ান্টরা যখন আরও বেশি অর্থ কামাই করছে, বাকি দুনিয়ায় তখন অর্থনৈতিক ধস অব্যাহত আছে।
বাস্তব অর্থনীতির সম্পদ ডিজিটাল আর্থিক সম্পদের অনেক নিচে পড়ে যাওয়ায় কে-আকৃতির একটি করপোরেট পুনরুদ্ধারের উদ্ভব হয়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে ডিজিটাল সংস্থাগুলোর বেড়ে ওঠার কোনো সীমা–পরিসীমা নেই, অথচ অন্যদের বিকাশ নির্ভর করে যে সীমিত পরিবেশে তারা পরিচালিত হয় তার ওপর। এ প্রবণতা মূল্য সৃষ্টির নব্য উদার ধারণাকেই শুধু চ্যালেঞ্জ করছে না; এটি আমাদের এমন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে মূল্য পুনর্গঠনের সরকারি নীতিও আর যুক্তিসংগত বিকল্প থাকছে না।
এ অবস্থার প্রতিকার করতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের কেউ কেউ কিছু প্রস্তাব করেছেন, যেমন ডিজিটাল সম্পদের ওপর কর। তবে অবাধ অর্থনীতির সমর্থকেরা এখনো জোর দিয়ে বলে চলেছেন, কোনো ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ বাজারের আরও বিকৃতিকেই শুধু সূচিত করবে।
আমরা অন্য তিনটি সমাধান প্রস্তাব করছি। প্রথমত, প্রযুক্তির প্রচার প্রসার এবং প্ল্যাটফর্ম এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্যকার প্রযুক্তিগত ফারাক নিরসনে সরকারি অনুদান ও ভর্তুকি ব্যবহার করা যেতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিতে ন্যায়সংগত প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা বাজারই করে দেবে—এ প্রত্যাশা না করে সরাসরি ছোট সংস্থাগুলোর কাছে পৌঁছাবে, এমন সব কর্মসূচিকে সরকার তহবিল জোগাতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আরও সপ্রাণ, বহু-অংশীদারি উদ্ভাবনী মডেল নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিত, যেখানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত না করেও অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিনিধিত্বর মতো বিষয়গুলো সমাধান করা হবে। এখানে অর্থনীতির নতুন মান শৃঙ্খলে বিজয়ী এবং পরাজিত পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসই হবে লক্ষ্য।
তৃতীয়ত, ‘ডিজিটাল সুরক্ষা’র উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করার সময় হয়েছে। স্থানীয় উদ্ভাবনকে উৎসাহ দিতে কিছু দেশ, যেমন বাণিজ্য শুল্ককে ব্যবহার করে, তেমনি স্থানীয় উদ্ভাবনী বাস্তুসংস্থানকে উৎসাহিত করতে ডিজিটাল শুল্ককে কাজে লাগানো যেতে পারে। সর্বত্র এটি কাজ করবে না। তবে যে জায়গাগুলো প্রযুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, সেখানে এই জাতীয় নীতি তৃণমূল উদ্ভাবনগুলোকে উৎসাহিত করবে।
প্রযুক্তিগত সুযোগ আর প্রবেশাধিকারের তীব্র সংকটের মুখোমুখি আমরা। ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিকে ধারণে অক্ষম আক্রমণাত্মক ব্যবসায়িক মডেলই যার কারণ। দামটা বড্ড চড়া, বাজারও সমস্যাটার সমাধান করবে না। কয়েকজনকে মাত্র নয়, ডিজিটাল বিপ্লবের মাধ্যমে অনেকের উপকার নিশ্চিত করার উপায়ও রয়েছে; কিন্তু তার জন্য নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে একুশ শতকে উদ্ভাবনকে আমরা কীভাবে দেখব।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, সর্বস্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● মার্ক এস্পোসিতো নেক্সাস ফ্রন্টিয়ারটেকের সহপ্রতিষ্ঠাতা, অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ৪ আইআর রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের সহনির্দেশক
● ল্যান্ড্রি সিনিয়ে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির থান্ডারবার্ড স্কুল অব গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টের প্রফেসর এবং সিনিয়র ডিরেক্টর। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিজিওনাল অ্যাকশন গ্রুপ ফর আফ্রিকার সদস্য
● নিকোলাস ডেভিস ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সোসাইটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগের প্রধান