মতামত

ডিজিটাল বাঘ, বোকা শিয়াল ও ফজা ভাইদের খেলা

ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পীরগঞ্জে জেলেপল্লিতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুক লাইভ কত মারাত্মক, তা বুঝেছে পীরগঞ্জ। সেখানকার মাঝিপাড়ার হিন্দুদের বাড়িঘরে যে আগুন দেওয়া হয়, যে ঘৃণা জাগানো হয়, তার মাধ্যম ছিল ফেসবুক। ঘটনার পরপরই এই লেখক পীরগঞ্জের উপদ্রুত গ্রামে যান। সেখান থেকে পাওয়া দুজনের দুটি ফেসবুক লাইভ এখন হাতে রয়েছে। কীভাবে একটি গ্রামের ঘটনা একটি উপজেলাকে জড়িত করে, কীভাবে আঞ্চলিক দৃশ্য জাতীয় চালচিত্র করে তোলা হয়, ভিডিও দুটি থেকে তা বোঝা সম্ভব। দুটি ভিডিওই লাইভ বা সরাসরি প্রচারিত হয়। শেয়ার হতে হতে দ্রুত তা অনেক মানুষের চোখে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, অনেককে আবার তাড়িত করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

মাঝিপাড়ার এক তরুণ ইসলামের অবমাননা করেছেন বলে রটনা হয়। তাতে সাড়া দিয়ে কয়েক শ মানুষ ওই পাড়ার দিকে যেতে থাকেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য, দুজন ইমামের নেতৃত্বে তাঁদের আটকানো হয়, শান্তও করা হয়। শান্তিবাদীদের সঙ্গে অশান্ত দঙ্গলের এই বাদানাবুদ, হইচই চলে দেড়-দুই ঘণ্টা। কেউ কেউ নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তা লাইভ করে দেখান। দীর্ঘ সময় লাইভের ফল হয় মারাত্মক। দূরদূরান্ত থেকে সুযোগসন্ধানীরা সংগঠিত হয়ে আসার সুযোগ পান। কারণ, তাঁরা জানেন, মাঝিপাড়ার ঘটনা জীবন্ত, গেলেই পাওয়া যাবে এবং তাঁরা এসেছিলেন।

দ্বিতীয় ভিডিওটি যিনি শেয়ার করেছেন, ভিডিওর সঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘৭১ দেখিনি, ২১ দেখেছি। ভুলব না।’ ভিডিওগুলো যে কমেন্ট পেয়েছে, সেসবও অহিংসামূলক। ভিডিও করার স্থান মাঝিপাড়া থেকে মাইলখানেক দূরে। মাঝখানে খোলা বিল ও ধানখেত হওয়ায় রাতের আকাশে দাউ দাউ লাল আগুন দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল না। ভিডিওকারীর উদ্দেশ্য হয়তো ছিল মাঝিপাড়ার আগুন দেখিয়ে প্রতিবাদ করা। কিন্তু দূরের আগুন দেখে আশপাশের কথাবার্তা, চিৎকার থেকে কিছু সত্য বেরিয়ে আসে। ভিডিওর সাত সেকেন্ডের মাথায় একজনকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের মুসলিম জাতি আগুনে পুড়ে শহীদ হয়ে গেল আর আমরা মুসলিম!’ আরেকজন তখন বলছিলেন, ‘এই সবাই আসো, আসো আসো।’ বোঝা যাচ্ছে, কে বা কারা ওই আগুন মুসলমানদের গায়ে লাগানোর গুজব রটিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করছেন। তাঁদেরই কেউ সেখানে জমায়েত হওয়া মানুষদের সংগঠিত করে নিয়ে যেতে চাইছেন ঘটনাস্থলে। কথা থেকে পরিষ্কার যে মুসলিমের গায়ে কাল্পনিক আগুন দেওয়ার কথা বলে হিন্দুপাড়ায় আরও হামলা চালানোই তাঁদের উদ্দেশ্য।

কিন্তু সেখানে অন্য মানুষও ছিলেন। একটি ভরাট গলা উত্তেজিত লোকদের বলছে, ‘অ্যাই, এখান থেকে চলি যাও, চলি যাও।’ একজন বলেন, ‘কী অবস্থা, কী অবস্থা!’ পাশের আরেকটি কণ্ঠ কেঁদে ফেলে বলে, ‘আল্লাহ, তুমি তোমার দীনকে রক্ষা করো আল্লাহ, কালকে এখান থেকে মুসলমান ভাইয়ের গন্ধ পাওয়া যাবে।’ এই বলে লোকটি আল্লাহ আল্লাহ বলে ডুকরে ওঠেন।

মাত্র ৩২ সেকেন্ডের ভিডিও। এই ভিডিও বিন্দুর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নকশা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এখানে আমরা পাচ্ছি তিনটি চরিত্র। এক চরিত্র আগুন দেখিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের মিথ্যা খবর দিচ্ছেন যে ওখানে, মাঝিপাড়ায়, মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ভিডিওতেও শুনেছি যে বলা হচ্ছে, মাঝিপাড়ার মন্দিরের ওখানে দুজন মুসলমানকে নাকি পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। স্পষ্টতই যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা হয় ভুল জেনেছেন, নয়তো তাঁদের উদ্দেশ্য অপরাধমূলক। দ্বিতীয় চরিত্র দায়িত্বশীল। তিনি লোকজনকে ভিড় না বাড়িয়ে চলে যেতে বলছেন। হয়তো তিনি টের পেয়েছেন যে এরা কিছু করবে। তৃতীয় মানুষটি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তিনি হয়তো গুজবে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু নিজে কিছু করার বদলে আল্লাহর কাছে বিচার দিচ্ছেন। পাশাপাশি সন্দেহ করছেন যে যা-ই হোক, যে-ই করুক, পরদিন এ ঘটনা মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যাবে। তাই বলছেন, ‘কালকে এখান থেকে মুসলমান ভাইয়ের গন্ধ পাওয়া যাবে।’
সম্ভবত হামলার উসকানি দেওয়া লোকেরা সেখান থেকে কিছু লোককে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

সংখ্যালঘুকরণের শিকার যে কেউই হতে পারে। একটি দেশে যারা সংখ্যাগুরু, তারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক কারণে সংখ্যালঘুর মতো বিপন্ন বোধ করতে পারে। বাস্তবে ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল ও দরিদ্র মুসলমান তার হিন্দু প্রতিবেশীর চেয়ে খুব কি নিরাপদ? সংখ্যাগরিষ্ঠতার মিথ্যা অহমিকায় এই সার্বিক অক্ষমতা ভুলে থাকা আত্মঘাতী হবে।

বিপ্লব টেলিভিশনে দেখানো হয় না, দেখানো হয় সংঘাত। ষাটের দশকের আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ছিল, ‘দ্য রেভল্যুশন উইল নট বি টেলিভাইজড’। টেলিভিশনের ধারাভাষ্য, বিজ্ঞাপন-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে মানুষের সত্যিকার আন্দোলন বিকৃত হয়ে যায়; ওই স্লোগান দিয়ে তৈরি করা বিখ্যাত একটি কবিতায় এটা বোঝানো হয়েছিল। পরে তা গানও হয়। একসময় টেলিভিশনের যে প্রভাব ছিল জনতার মনের ওপর, এখন তা করছে ফেসবুক। ফেসবুক দিয়ে বিপ্লব না হলেও প্রতিবিপ্লবী সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক আক্রোশ ছড়ানো অনেক সহজ। কিছু দরকার নেই, একটি ভিডিও বা ছবি এবং কিছু বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাই একটি গ্রাম বা একটি শহর, এমনকি একটি দেশকেও অশান্ত করে তুলতে যথেষ্ট।

এ কাজের কাজিও কম নেই। ডিজিটালাইজড হয়েছে সব রকমের যোগাযোগের। মানুষের মন যত না সমাজসংশ্লিষ্ট, তার চেয়ে বেশি নেট-কানেকটেড। বাস্তবের ভাই-বন্ধু-প্রতিবেশীদের নিয়ে আগে সমাজ হতো, পরিচয় তৈরি হতো যে আমি অমুক এলাকার অমুকের ছেলে। এখন পরিচয় তৈরি হয় ফেসবুকের স্ট্যাটাস-কমেন্ট-ফলোয়ারে। ভূরুঙ্গামারীর মকবুল হয়তো মুখচোরা লোক, কিন্তু পটিয়ার সবুজের সঙ্গে তাঁর অনেক কথা হয়, উভয়ে উভয়কে ভালো পান। তাঁরা হয়তো একটি গ্রুপ চালান। সেখানে অনেকে তাঁদের মতামতের অনুসারী হন। এভাবে নিজ এলাকার গৌণ ছেলেটি ফেসবুকে হয়ে ওঠেন এলিট। যাঁর যত ফলোয়ার, যাঁর যত ভিউ, তিনি তত বড় এলিট। এই নয়া এলিটদের মধ্যে ডান-বাম-আস্তিক-নাস্তিক—সব রঙের লোক আছেন।

ফেসবুক ব্যবহার করে ক্ষমতায়িত এই এলিটরা তাঁদের ঘরানার লোকদের নিয়ে সমাজ গড়ে তোলেন। পীরগঞ্জের যে সৈকত মণ্ডল মাঝিপাড়ার পরিতোষের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে উসকানি দিয়েছেন বা কুমিল্লায় যাঁরা পূজা মণ্ডপে কোরআন অবমাননার ভিডিও প্রচার করেছেন, এই অশান্তি সৃষ্টিতে তাঁদেরও হাত আছে। আরেক হাত অবশ্যই নজরের বাইরে থাকা, সিসিটিভির ক্যামেরার বাইরে থাকা রিংমাস্টারদের। যাঁরা মানুষের জীবনকে সাম্প্রদায়িক হিংসার সার্কাস বানাতে ওস্তাদ। উন্নয়নশীল দেশের বিপুল বেকার ও নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থানের তরুণেরা এদের হাতে সহজেই পড়ে।আড়ালের ষড়যন্ত্রকারীরা তখনই সফল হন, যখন ফেসবুকের এই নয়া এলিটরা জেনে বা না জেনে তাঁদের পাতা ফাঁদে পা দেন। বিশ্বব্যাপী পরিচয়বাদী উগ্র ডানপন্থার উত্থানের পদাতিক সেনা হলো এই ডিজিটাল বাঘ সেজে থাকা বিড়ালেরা।

বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ২০১৭ সালে আড়াই হাজার সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর ফেসবুক পেজ শনাক্ত করেছিল। ভারতে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন ২০১৮ সালে বছরব্যাপী অনুসন্ধানে দেখতে পায়, ১২ মাসে ঘৃণা প্রচারকারী পোস্ট ও পাল্টা পোস্ট ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৩০ শতাংশ। তখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরুর মাংস বহনের ‘অপরাধে’ মুসলমানদের পিটিয়ে-পুড়িয়ে মেরে ফেলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশেও ফেসবুককেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক রটনা ও বিদ্বেষ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। হিন্দু-মুসলিম উভয় তরফের নামেই এটা চলছে। বাংলাদেশের জনগণকে এখন বলতে হবে যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আমাদের নামে করা যাবে না। মুসলমানের নামে, হিন্দুর নামে, বাংলাদেশিদের নামে কারও জান-মাল-মর্যাদার ক্ষতি করার দায় সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির। সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবে মানুষের সমানাধিকার কায়েম করতে হলে সাম্প্রদায়িক ফাটলরেখা বোজাতেই হবে। এর জন্য ফেসবুকে ও বাস্তবে ঘৃণা সৃষ্টিকারীদের গণনজরদারির মধ্যে ফেলতে হবে, তাঁদের বয়কট করতে হবে, তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকারপ্রধানের অবমাননার অভিযোগে কত মানুষ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আটক হলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উসকানির কুশীলবদের বেলায় শিথিলতা কেন? ঘরপোড়া আগুনে আলুপোড়া খাওয়ার লোকের অভাব নেই।

এই দুঃসময়ে মনে রাখা দরকার, সংখ্যালঘুকরণের শিকার যে কেউই হতে পারে। একটি দেশে যারা সংখ্যাগুরু, তারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক কারণে সংখ্যালঘুর মতো বিপন্ন বোধ করতে পারে। বাস্তবে ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল ও দরিদ্র মুসলমান তার হিন্দু প্রতিবেশীর চেয়ে খুব কি নিরাপদ? সংখ্যাগরিষ্ঠতার মিথ্যা অহমিকায় এই সার্বিক অক্ষমতা ভুলে থাকা আত্মঘাতী হবে। বোকা শিয়ালের গল্পটাও আমরা জানি, ‘মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে/ লাগলে খিদে মুরগি এঁকে দেয়ালে/ আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে।’

ফেসবুক হলো সেই ঘৃণার দেয়াল, যেখানে ঘৃণার ছবি আঁকাআঁকি আসলে বোকারই কাজ। শিয়াল তো নিজেকে চালাকই ভাবে, কিন্তু আড়াল থেকে মজা মারে শিকারি ফজা ভাইয়েরা।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক। faruk.wasif@prothomalo.com