মতামত

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তরুণদের মনে রাখছে না

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বন্দীদের বেশির ভাগই তরুণ
ছবি: প্রথম আলো

‘আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না, যা বিশ্বাস করি বলি। সে জন্য বিপদেও পড়তে হয়, এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা নম্বর: ২১৮)

অধিকাংশ তরুণ এভাবেই ভাবে। ওপরের কথাগুলো যিনি বলেছেন, তিনিও তখন তরুণই ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু যখন এটা লিখছিলেন, তখন তাঁকে তরুণই বলা যায়। তিনি যে দলটির নেতা হন, সেই আওয়ামী লীগও তখন ছিল বয়সে ও সমর্থনের দিক থেকে তরুণের দল। সে সময়ের উঠতি মধ্যবিত্তের সন্তান তথা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাই ছিল এই দলের মূল বাহন।

এ উঠতি মধ্যবিত্তের বা নিম্ন মধ্যবিত্তের তরুণেরাই পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগকে বারবার আন্দোলনে ও নির্বাচনে জয়ী করেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়, তারও অন্যতম প্রধান রসদ ছিল সে সময়ের নতুন ভোটারদের মধ্যে এই দলটির জনপ্রিয়তা। সে সময় আমাদের জনসংখ্যার মৌলিক এক পরিবর্তনও ঘটে যায়। তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই দেখা দেয় জনগণের প্রধান অংশ হিসেবে। এই যে পপুলেশন ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা, তা আওয়ামী লীগের পালে বাতাস দেয়। ভোটারের সংখ্যার মধ্যেও এর প্রতিফলন ঘটে। যেহেতু সে সময়ের বাস্তবতায় দুটি প্রধান দলের ভোটভিত্তি মোটামুটি কাছাকাছি ছিল, সেহেতু নতুন ভোটাররা যেদিকে বেশি যাবে, তারাই জয়ী হবে। এবং সেটাই হয়েছিল। আওয়ামী লীগও তাদের আকর্ষণ করতে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান দিয়েছিল।

কিন্তু ২০২১ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তরুণদের মনে রাখেনি। তরুণদের মনে রেখেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনে বন্দীদের বেশির ভাগই তরুণ। উন্নয়নের সুফলও তরুণেরা ততটা পায়নি। সরকারি সংস্থা বিবিএসের জরিপ জানিয়েছিল দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। কিন্তু আইএলওর প্রতিবেদন বলছে, বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। ব্রিটেনের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হিসাবে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।

বেকারত্ব নিয়ে তরুণদের হতাশা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কিশোর-তরুণদের সামাজিক অসন্তোষ ফেটে পড়েছিল সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনে। এখন যেমন তারা আন্দোলন করছে তরুণবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে, এ আইনের দ্বারা নিপীড়িত লেখক মুশতাক আহমেদের কারামৃত্যুর প্রতিবাদে।

তরুণেরা এ সরকারকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। শাহবাগ গণজাগরণের সময় তারাই আওয়ামী লীগের সব প্রতিপক্ষকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। অনলাইন লেখকদের বেশির ভাগই ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের’ অনুকূলে। কিন্তু কী হয়েছে? সরকার তাদের পরিত্যাগ করেছে। অনেকের অপমৃত্যু সরকার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী এ সরকারের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। সরকারের রোষানল থেকে কিশোরেরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। সর্বশেষ রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন লেখক ও উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ।

এ সময়ে আরও অনেক কিছু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবির হাটসহ তরুণদের মিলিত হওয়ার অনেক জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একদিকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির শত্রু ঘোষিত হওয়ার হুমকি, অন্যদিকে অনুভূতিতে আঘাতের কার্ড ব্যবহার করে তরুণদের বোবা করে দেওয়া চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে জবানের স্বাধীনতা কাটা পড়ছে।

ঠিক এ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার কি তরুণদের মনের ভাষা বোঝে। আওয়ামী লীগ একসময় বুঝত, যখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মহানায়ক ছিলেন। লাখো তরুণ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে তিনি তার প্রতিদান দিয়েছেন। তাহলে ২০০৭-২০০৮ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত যে তরুণেরা আওয়ামী লীগের হাত শক্তিশালী করেছিল, প্রতিদানে তারা কী পেল?

অথচ তরুণেরাই ভবিষ্যৎ, জনসংখ্যার মধ্যে এককভাবে তারাই বেশি। তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করাই দেশপ্রেম। আওয়ামী লীগ এ সত্য ভুলে গেছে যে তরুণেরাই বারবার আওয়ামী লীগের নৌকাকে ভাসিয়ে রেখেছে। অথচ আজ বঙ্গবন্ধুর ভাষাতেই বলতে হয়,

‌‘পাকিস্তানের ১৯ বৎসরে যা দেখলাম তা ভাবতেও শিহরিয়া উঠতে হয়। যেই ক্ষমতায় আসে সেই মনে করে সে একলাই দেশের কথা চিন্তা করে, আর সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী আরো কত কি। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দী রেখে অনেক দেশনেতাকে শেষ করে দিয়েছে। তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে, সংসার ধ্বংস করে দিয়েছে। আর কতকাল এই অত্যাচার চলবে কেই বা জানে! এই তো স্বাধীনতা, এই তো মানবাধিকার!’

গ্রাম-শহরের উঠতি মধ্যবিত্তরাই ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর অবধি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। উঠতি মধ্যবিত্তের ক্ষোভে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। সেই উঠতি মধ্যবিত্ত, যারা তাদের প্রথম প্রজন্মের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় প্রথমবারের মতো পাঠিয়েছে, তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। এখন তাদের প্রায় সাড়ে তিন কোটি বেকার। দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন হয়ে বর্তমান পর্যন্ত যা কিছু সামাজিক আলোড়ন, তা-ও আসছে এই উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। কারণ, জনসংখ্যা সুবিধা, অর্থনৈতিক, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল থেকে তরুণদের বঞ্চিত করা হয়েছে। উঠতি মধ্যবিত্ত তরুণদের ক্ষোভই আধুনিক জমানার রাজনৈতিক পালাবদলের প্রধান জ্বালানি। এ উঠতি মধ্যবিত্তদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ কোথায় যেতে চায়?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক

faruk.wasif@prothomalo.com