ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: প্রতিবাদ এখানে অবিচ্ছেদ্য

২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৯টি ধারা সংশোধনের দাবিতে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন।
ছবি: প্রথম আলো

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (ডিএসএ) সমালোচনায় যে কথাগুলো এত দিন বলা হয়েছে, সেগুলো এই যে এটি একটি ড্রাকোনিয়ান আইন, অর্থাৎ অত্যন্ত কঠোর বা কড়া। বলা হয়ে থাকে, এই আইনে এমন কিছু ধারা আছে, যা খুব অস্পষ্ট বা ভেগ। এই অস্পষ্টতা বা ভেগনেসকে ব্যবহার করে যাকে খুশি তার বিরুদ্ধে সরকার বা তার তল্পি বাহিনীর কেউ মামলা করে দিতে পারে এবং পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারে! আইনটিতে পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলেও বিশ্লেষণ রয়েছে।

এ আইনের বাতিল চেয়ে সচরাচর যে কথাগুলো বলা হয়, সেগুলো এ রকম: আইনটি নিবর্তনমূলক, ‘মুক্তবুদ্ধির’ চর্চার পরিপন্থী এবং বাংলাদেশে ‘বাক্‌স্বাধীনতার’ পরিসরকে সংকুচিত করছে। অনেকের বিশ্লেষণে আইনটির উদ্দেশ্যই একটা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ উৎপাদন করা, যাতে মানুষ প্রশ্ন করতে ভয় পায়, সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে বা অভিযোগ তুলতে বা সমালোচনা করতে ভয় পায়। আইনটিতে সরকারের সমালোচনা আর রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনাকে এক করে দেখা হয় বলেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। এর ফলে সরকারের সমালোচনাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ কাতারে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সংগত কারণেই দেশের তরুণ, নেটিজেনসহ বুদ্ধিজীবী-সমাজের একটা অংশ ও সাংবাদিক নেতৃত্বের একটা অংশ (সম্পাদক পরিষদ) অত্যন্ত সোচ্চার কণ্ঠেই আইনটির বিরোধিতা করে আসছে। আইনটির বাতিল চেয়ে কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে মুখর।

আইনটি নিয়ে বিশ্লেষণের যে ধারা সচরাচর চোখে পড়ে না, সেটি হচ্ছে এ আইনের উসকানিমূলক দিক। আইনটিতে কিছু বিষয়ের অবতারণা করে নাগরিকদের সে বিষয়ে (সামাজিক মাধ্যমে) মন্তব্য করতে বিরত থাকতে বলার মধ্যে বা কিছু বিষয়কে ব্লাসফেমি হিসেবে পরিগণিত করার মধ্য দিয়ে আইনটি অবিরত, সেগুলো নিয়েই বরং আরও বেশি কথা বলতে নাগরিকদের উসকানি দেয়।

আইনটি নিয়ে বিশ্লেষণের যে ধারা সচরাচর চোখে পড়ে না, সেটি হচ্ছে এ আইনের উসকানিমূলক দিক। আইনটিতে কিছু বিষয়ের অবতারণা করে নাগরিকদের সে বিষয়ে (সামাজিক মাধ্যমে) মন্তব্য করতে বিরত থাকতে বলার মধ্যে বা কিছু বিষয়কে ব্লাসফেমি হিসেবে পরিগণিত করার মধ্য দিয়ে আইনটি অবিরত, সেগুলো নিয়েই বরং আরও বেশি কথা বলতে নাগরিকদের উসকানি দেয়। এ আইনের কারণে সাধারণ মানুষ জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। মানুষ এককাট্টা হচ্ছে। এটাকে একটা ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখা যায়! প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নানাভাবে বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ইত্যাদি প্রবণতা দেখা গিয়েছে, যার কারণে সে দেশেও সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা দেখা গেছে।

এ আইনের কারণেই বাংলাদেশে ‘বাক্‌স্বাধীনতা’, মুক্তবুদ্ধির চর্চার মতো বিষয়গুলো নিয়ে একটা আলোচনার আধিক্য দেখা যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বাক্‌স্বাধীনতা’ কথাটা সংবিধানে থাকলেও জনপরিসরে এই বিষয়গুলো বা মুক্তবুদ্ধির চর্চা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলাপ এর আগে কখনো হয়েছে কি? মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের বিষয়। বিদ্যায়তনিক পরিসরেই ছিল এর বিচরণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ আইনের কল্যাণে সৃষ্ট দমনপীড়ন বাক্‌স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা প্রসঙ্গগুলোকে বারবার জনপরিসরে নিয়ে আসছে। আলোচনা হচ্ছে নানা ব্লগস্পিয়ারে (যার কোনো নির্দিষ্ট দেশ নেই), যার প্রভাব সমাজে কম নয়। এসব আলোচনা একসময়ের উচ্চবর্গীয় সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের সরু পরিসর থেকে বের হয়ে ডিএসএর দম বন্ধের মধ্যে দিন দিন নতুন পরিসর পাচ্ছে। আইনটির ইতিবাচক ফল হিসেবে এই বিষয়গুলোকে আমাদের বিশ্লেষণ কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসা দরকার।

ফেসবুক ফিডের কথাই ধরা যাক। বার্গার খেতে যাওয়ার সেলফি তোলা বাদ দিয়ে একজন ফেসবুকবন্ধু দেখলাম লিখেছেন, ‘খাদ্যের থেকেও বাক্‌স্বাধীনতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ বা এই রকম কিছু। এ রকম ভাবনা এখন সামাজিক মাধ্যমের হাটে-ঘাটে-মাঠেই পাওয়া যায়। ডিএসএর কারণেই কি এসবের গুরুত্ব আমাদের কাছে নতুনভাবে এবং অভিনব কায়দায় হাজির হচ্ছে না? আইনটি মনে করিয়ে দেয়, একসময় বাংলাদেশে কার্টুন ছাপা হতো; নানা ইঙ্গিতপূর্ণ সেসব কার্টুনের বিষয় হিসেবে সরকারপ্রধান থেকে রাস্তার ‘টোকাই’—কেউই বাদ যেত না।

আইনটির মাধ্যমে সরকার কিছু বিষয় বা প্রসঙ্গকে ইনডেমনিটিফাই করতে চেষ্টা করছে। এই ধরনের ইনডেমনিটি কেবল দুটি কাজই করবে—ক. কিছু আলোচনাকে রুদ্ধ করে দেবে, তৈরি করবে বদ্ধাবস্থা; খ. এ আইনে যা যা বলতে মানা করা হচ্ছে, তা বলার পথ খুঁজবে মানুষ। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার মন্তব্য পাতায় সাধারণ মানুষের মন্তব্য দেখলে সেটা খানিকটা আঁচ করা যায়।

স্বাধীনতার ৫১তম বছরে এসে আমরা যে স্বাধীনভাবে এবং নানা যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে সবার অংশগ্রহণে কোনো আলাপ দেখতে পারছি না, তারও কারণ এই আইনসৃষ্ট সেলফ সেন্সরশিপ। কেননা, বিজ্ঞজনেরা যা-ই বলুন না কেন, অনেকে ধরে নিতে পারেন, যা বলা হচ্ছে, তা আইনটির প্রভাববলয়ে থেকেই। তাই ইতিহাসের সত্য নিয়ে কথা বলবে না অনেকেই। যেমনটা একটু আগেই বলেছিলাম: কিছু আলোচনাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে এই আইন। এভাবে ডিএসএর প্রভাব কেবল সামাজিক মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে না; এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ। তবে সরকার বা তার নীতিনির্ধারকেরা (নীতিনির্ধারক কথাটা নব্য উদারনৈতিক রাষ্ট্রের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অর্থহীন হয়তো, অভ্যাসগত কারণে ব্যবহার করলাম এখানে!) এই ক্ষতির পরিমাণ অবশ্য অনুধাবন করতে পারছেন না এখনো।

কিন্তু একই সঙ্গে ডিএসএ মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতার গুরুত্বকে। কারণেই মনে হয় বলার, লেখার, প্রশ্ন করার ক্ষমতা থাকা কতটা জরুরি, তা অনুভব করার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়! আমরা যারা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও আন্দোলনকর্মী, সমাজ নিয়ে ভাবি বা গবেষণা করি বা লড়াই করি, আমাদের জন্য এই আইনকে প্রশ্ন করার, এর বাতিল চাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবাদ এখানে অবিচ্ছিন্ন। এ আইনই সরকার, রাষ্ট্র, পুলিশ, নাগরিক অধিকার ও আইন আদালত নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করছে প্রতিনিয়ত।

স্বাধীনভাবে বলার, লেখার জন্য মানুষ কাতর; যখন লিখতে পারছে না, আশ্রয় নিচ্ছে নানা ধরনের স্যাটায়ার বা প্রতীকের ওপর। স্যাটায়ারভিত্তিক সাইটগুলো এখন সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এগুলো প্রতিরোধেরই নানা ধরন ও চর্চা, যা নাগরিকেরা ক্ষমতাকে প্রতিহত করতে ব্যবহার করছে এবং যা অনুভূত হয় আমাদের রোজকার জীবনে। এগুলো সব ক্ষেত্রে বড় ব্যানার আর লাল ঝান্ডা নিয়ে না এলেও একে হালকাভাবে নেওয়াটা বোকামি। প্রতিরোধের এ ভাষা তৈরিতে আইনটা কাজে দিচ্ছে!

ড. মাহমুদুল সুমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।