মতামত

ডিএনএ ও জীবপ্রযুক্তি: আর কত উপেক্ষা

পুরো পৃথিবী যখন কোভিডে আক্রান্ত, তখন দুটো দেশে লোকজন নিশ্চিন্তে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা হলো অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। দুটো দেশই জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এ মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এ দুটি দেশ এখন কোভিডমুক্ত (জিরো কোভিড)।

বাংলাদেশ যখন শুধু তৈরি পোশাক বাণিজ্য করে বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি টাকা উপার্জনে ব্যস্ত, তখন ইনসুলিন, গ্রোথ হরমোন আর ব্লাড ক্লটিং ফ্যাক্টরের ব্যবসা করে শত শত কোটি ডলার উপার্জন করছে ভারত ও উন্নত দেশগুলোর উদ্যোক্তারা। সম্প্রতি কার-টি সেল থেরাপি উদ্ভাবন করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি একাই প্রতিবছর কোটি ডলার আয় করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

এ তিন সাফল্যের একটিই রহস্য, তা হলো গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ডিএনএ গবেষণা ও জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও গুরুত্ব দেওয়া। পুরো বিশ্ব যখন ডিএনএর তথ্য ও জীবপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে, কৃষি ও খাদ্যক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছে, ওষুধের ক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্য পাচ্ছে, বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্মুক্ত করছে নতুন নতুন দুয়ার, তখন বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে আছে? উদাসীনতা না অজ্ঞতার কারণে?

আজ বিশ্ব ডিএনএ দিবস। জীববিজ্ঞানীদের কাছে ডিএনএ এক অসীম সম্ভাবনার দুয়ার। একই সঙ্গে রহস্যের এক বিশাল জগৎ। মানুষ, পশুপাখি, উদ্ভিদ বা অণুজীবের কোষের নিউক্লিয়াসে (এবং কারও কারও ক্ষেত্রে মাইটোকন্ড্রিয়া ও অন্য অঙ্গাণুতে) থাকে ডিএনএ। জীবকোষের সব কর্মকাণ্ডের মূলে জড়িয়ে আছে এ ডিএনএ এবং তার মধ্যে থাকা জিন। সব জিনকে একসঙ্গে বলা হয় জিনোম।

আমাদের ত্বকের রং থেকে শুরু করে উদ্ভিদের প্রজননক্ষমতা, গরুর দুধ উৎপাদনক্ষমতা, খাদ্যের পুষ্টিগুণের তারতম্য—সবকিছুতে জড়িয়ে আছে জিনের কর্মকাণ্ড। জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বংশগতি। বংশগতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে ডিএনএ। ১৯৫৩ সালে দ্বিসূত্রক ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করেন জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক। এর পেছনে ছিলেন আরও একজন নারী রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন।

সাম্প্রতিক করোনা মহামারি পৃথিবীতে দেখিয়ে দিয়েছে ডিএনএ গবেষণা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে জনকল্যাণে কাজে লাগতে পারে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট প্রাণী বা অণুজীবের সব জিনের বৈশিষ্ট্য জানা যায়, চিহ্নিত করা যায় এবং কোনো জিনের মধ্যে অস্বাভাবিকতা থাকলে তা অনুসন্ধান করা যায়। করোনাভাইরাসের নিয়মিত জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ খুব দ্রুত জেনে যাচ্ছে কোন দেশ থেকে কোন ধরনের ভেরিয়েন্ট বা নতুন ধরন সেই দেশে ঢুকল। সে অনুযায়ী অনেক দেশই বিমানপথে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির সার্স কভ-২–এর অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করেছে।

জিনোম সিকোয়েন্সিং জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও কাজে লাগতে পারে। আমাদের দেশের যেসব জায়গায় দক্ষিণ আফ্রিকান কিংবা ব্রিটিশ বা ব্রাজিলিয়ান ধরনের করোনাভাইরাস বেশি দেখা যাচ্ছে, সেসব জায়গায় সংক্রমণের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। নিয়মিত ৫-১০ শতাংশ কোভিড রোগীর নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে যদি সেসব জায়গা চিহ্নিত করা যায়, তাহলে সেসব জায়গাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ বিস্তার ঠেকানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সুযোগ আছে মাত্র আটটি প্রতিষ্ঠানে। তার মধ্যে আবার তিনটিতে রয়েছে অজস্র আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। দেশে জীবপ্রযুক্তি গবেষণার মূল প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতেই এখন পর্যন্ত ভাইরাস বা এ রকম অণুজীবের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সর্বাধুনিক যন্ত্র মিনিসেক মেশিন নেই।

জীবপ্রযুক্তির দ্রুতবেগে ধাবমান যে ট্রেনটিতে চড়ে পৃথিবী এখন রোগমুক্তি, খাদ্যসংকট সমাধান, প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্থ ব্যবহার ও বেকারত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন দেখছে, সেই ট্রেনটিতে উঠতে বড্ড বেশি দেরি করে ফেলছে বাংলাদেশ। এভাবে চলতে থাকলে আমরা হয়তো এমন ট্রেন আর পাব না

ফরেনসিক ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীকে সহজে চিহ্নিত করা যাচ্ছে, ধর্ষককে শনাক্ত করা যাচ্ছে, প্রমাণ করা যাচ্ছে পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব। মেটাজিনোমিকস নামের একটি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই কোন খাদ্যে কী কী অণুজীব আছে, তা চিহ্নিত করা যায়। এতে মানহীন খাদ্য তৈরি হচ্ছে কি না বা হঠাৎ কোনো খাবারে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের আধিক্য দেখা যাচ্ছে কি না, তা শনাক্ত করা যায়। বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করতে পারে জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার। লবণসহিষ্ণু ধান নিয়ে গবেষণা করছেন দেশ ও বিদেশের বিজ্ঞানীরা। এতে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি যেমন প্রতিরোধ করা সম্ভব, তেমনি শত শত কোটি টাকা উপার্জনেরও এক পথ বায়োটেকনোলজি এবং ডিএনএভিত্তিক প্রযুক্তি।

একটা টিকা আবিষ্কারের জন্য একসময় মানুষকে ৭০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু এখন মাত্র এক বছরেই বাজারে আসছে সার্স কভ-২–এর টিকা। যদিও অনেক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শর্ত উপেক্ষা করে এত দ্রুত সময়ে অনুমোদন পেয়েছে এ টিকা জরুরি অবস্থা বিবেচনায়, কিন্তু বায়োইনফরমেটিকস নামের একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের সমন্বয়ে মানুষ খুব অল্প সময়ে এখন খুঁজে নিতে পারে টিকার নকশা। ৫০ কিংবা ৭০ বছর অপেক্ষার দিন শেষ। এভাবেই জীবপ্রযুক্তি স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন দিনের।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে জীবপ্রযুক্তি খাত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ১০টি খাতের একটি। কিন্তু আমাদের দেশে এর কোনো মূল্যায়ন নেই। প্রতিবছর ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় এক হাজার স্নাতক বের হচ্ছেন, কিন্তু বায়োটেকনোলজিস্ট বলে কোনো পদই নেই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানে এ রকম কয়েকটি পদ আছে, তা–ও আবার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা বায়োটেকনোলজি বিষয়ের ছাত্রদের নিয়োগই করা হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অথচ দেশের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানে বায়োটেকনোলজির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা সম্পর্কিত কাজ হচ্ছে কিন্তু এর কোথাও জীবপ্রযুক্তিবিদদের স্থান নেই।

অনেক দেশে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির মতো জীবপ্রযুক্তি খাতে এগিয়ে আসতে। তারা কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে জীবপ্রযুক্তি খাতে। কিন্তু আমাদের দেশে এদিকে কোনো নজর নেই। গত তিন বছরে জাতীয় পর্যায়ের বেশ কিছু উদ্ভাবন, স্টার্টআপ ও তরুণ উদ্যোক্তাবিষয়ক প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কোথাও জীবপ্রযুক্তি নিয়ে কোনো তথ্য বা উৎসাহ দেখতে পাইনি। জীবপ্রযুক্তি যে একটা বিরাট সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ হতে পারে, তা কেউ ভেবেও দেখছেন না।

জীবপ্রযুক্তির দ্রুতবেগে ধাবমান যে ট্রেনটিতে চড়ে পৃথিবী এখন রোগমুক্তি, খাদ্যসংকট সমাধান, প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্থ ব্যবহার ও বেকারত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন দেখছে, সেই ট্রেনটিতে উঠতে বড্ড বেশি দেরি করে ফেলছে বাংলাদেশ। এভাবে চলতে থাকলে আমরা হয়তো এমন ট্রেন আর পাব না।

আদনান মান্নান শিক্ষক ও গবেষক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

adnan.mannan@cu.ac.bd