ডা. শামশাদ আলী

শহীদ বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, পার্বতীপুর, দিনাজপুর, রংপুর

ডা. শামশাদ আলী
ডা. শামশাদ আলী

পেশায় চিকিৎসক হলেও শামশাদ আলী ছিলেন ভিন্ন স্বভাবের মানুষ। বন্ধুবৎসল, আড্ডাবাজ, দাপুটে ও পরোপকারে অগ্রণী। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। আড্ডাবাজ ছিলেন বলে এমবিবিএস পাস করার পর সরকারি চাকরি পেয়েও মন বসাতে পারেননি। শেষে চলে আসেন পৈতৃক নিবাস দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। এখানেই শুরু করেন চিকিৎসা-ব্যবসা। তবে এটাকে ব্যবসাও বলা যাবে না, বিনা ফিতে গরিব মানুষের চিকিৎসা ও পরের উপকার করে বেড়ানোই ছিল তাঁর কাজ। গরিব–দুঃখী মানুষের তিনি ছিলেন অতি আপনজন। যা আয় করতেন, তার বেশির ভাগই ব্যয় করতেন গরিবদের জন্য। এ কারণে পার্বতীপুরের বয়স্ক বাঙালিরা আজও তাঁকে ভুলতে পারেনি।

১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে শামশাদ আলী পার্বতীপুরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে পার্বতীপুরে বসবাসরত অবাঙালিদের বিরাগভাজন হন তিনি। তারা তখন থেকেই তাঁকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৯ এপ্রিল রাত ১১টায় পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালিরা তাঁর পৈতৃক বাড়িতে হামলা চালায়। পরিস্থিতি অনুমান করে তিনি ছাদের কার্নিশের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। অবাঙালিরা তাঁকে খুঁজে বের করে। তাঁর বিশাল দেহ হারিকেনের আলোয় ঠিকই চোখে পড়ে।

অবাঙালিরা পরে তাঁকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। পার্বতীপুর স্টেশনে সব সময়ই কয়লাচালিত একটা ইঞ্জিন রাখা থাকত।

শামশাদ আলীকে তারা সেই ইঞ্জিনের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে হত্যার পর তাঁর শরীর কয়েক টুকরো করা হয়।

এরপর শরীরের খণ্ডিত অংশগুলো ইঞ্জিনের জ্বলন্ত কয়লার চুল্লিতে ফেলে দেওয়া হয়।
এ ঘটনা সম্পর্কে আরও জানা যায় শামশাদ আলীর ভ্রাতৃবধূ সেকো আফতাবের আমার ভাশুর রচনা থেকে।

তিনি লিখেছেন, ‘কুখ্যাত বাচ্চা খান ও সোয়েব কন্ট্রাক্টর পার্বতীপুরে অবাঙালিদের নেতা ছিল।

অবাঙালি যাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল, তারা একাত্তরে হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল। ২৫ মার্চের পর অবাঙালিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে পার্বতীপুর ছেড়ে যাওয়া যায়, তা ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে গেল। এরপর এল সেই বিভীষিকাময় রাত।


‘৯ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ও ভারী বুটের লাথি। দরজা না খুললে ভেঙে ফেলবে, এই ভয়ে আমার স্বামী দরজা খুলে দিলেন।

দরজার সামনে বাচ্চা খানের ভাতিজা জাকির খান এবং তার সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা নয়জন পাকিস্তানি সেনা।

তারা তল্লাশির কথা বলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। একে একে সবাইকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে সব গয়না ও টাকাপয়সা গুছিয়ে দিতে বলল।

দোতলায় আমার ঘুমন্ত ভাশুর শামশাদ আলী সদর দরজায় বুটের লাথির শব্দ পেয়ে বিপদ আঁচ করতে পেরে ছাদের কার্নিশে লুকিয়ে পড়েন।

আর্মি ও অবাঙালিরা হারিকেনের আলোতে একতলা-দোতলা তল্লাশি করতে করতে একসময় ছাদের কার্নিশে লুকিয়ে থাকা আমার ভাশুরকে দেখে ফেলে।

এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে তাঁকে নিচে নামিয়ে এনে অন্য চারজনের সঙ্গে দাঁড় করায়।

এরপর সোনাদানা ও টাকাপয়সা হস্তগত করে তারা ধরে নিয়ে গেল আমার ভাশুরকে। দরদি এ মানুষটিকে তারা আর ফিরে আসতে দেয়নি তাঁর আপন সংসারে।


‘পরে শোনা গেছে, মির্জা খান নামের কুখ্যাত এক অবাঙালি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

এরপর তাঁর দুই বাহু কাঁধ থেকে এবং শরীর কয়েক টুকরো করে কেটে ইঞ্জিনের কয়লার চেম্বারের গনগনে আগুনে ছুড়ে দেয়।

এত নিষ্ঠুর ও পিশাচ মানুষ হতে পারে, বিশ্বাস হতে চায় না।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বাদশ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।


শামশাদ আলীর জন্ম পার্বতীপুরে। বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. আবুল হোসেন।

মা আনোয়ারা বেগম। তিনি নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর বংশধর ছিলেন। শামশাদ আলীর বাবার আদি পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার সোনাতলা থানায়।

তাঁর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পার্বতীপুরে স্থায়ী হন। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

পার্বতীপুর থেকে ম্যাট্রিক ও আইএ পাস করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এখানে বেশি দিন পড়াশোনা করেননি। পরে ভর্তি হন মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে। এখান থেকেই তিনি এমবিবিএস পাস করেন।


শামশাদ আলী চার ছেলেসন্তানের জনক। তাঁরা হলেন মো. ফাইয়াজ আলী (ব্যবসায়ী), মো. ইরশাদ আলী, মো. ইমতিয়াজ আলী (চাকরিজীবী) ও মো. শমসের আলী (প্রবাসী)। স্ত্রী শামসুন্নাহার বেগম।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info