যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা কি শক্তিশালী নেতা নির্বাচন করবেন, নাকি গণতান্ত্রিক নেতাকে ক্ষমতায় বসাবেন, তার পরীক্ষা হবে আগামী ৩ নভেম্বর। ডোনাল্ড ট্রাম্প সব সময়ই নিজেকে শক্তিশালী নেতার ভাবমূর্তিতে রাঙাতে চেয়েছেন। চীন বা রাশিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়ার নেতাদের চেয়ে তিনি কত শক্তিশালী, তা বোঝাতে কতই–না হাস্যকৌতুকের জন্ম দিয়ে চলেছেন। করোনাও যে তাঁর কিছুই করতে পারবে না, তা বোঝাতে একবার হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আরেকবার হোয়াইট হাউসের বারান্দায় দর্শন দিয়ে ভক্তদের চমকে দিলেন। প্রথম মেয়াদে শক্তিশালী ট্রাম্প চান দ্বিতীয় মেয়াদে আরও শক্তিমান হয়ে হাজির হতে। কিন্তু ‘রিএনফোর্সড’ ট্রাম্প জয়ের শিরোপা পেলে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তা ভালো না মন্দ, সেই প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে। প্রশ্নটা আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়া বলা যাবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আমাদের মতো দেশের পররাষ্ট্রনীতি শুধু নয়, রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে।
ট্রাম্পের পক্ষে প্রথম কথা হলো, তিনি কোনো যুদ্ধ করেননি। বারাক ওবামা শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের মুকুট মাথায় নিয়ে লিবিয়া ও সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, ইরাক ও আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন টিকিয়ে রেখেছিলেন। সুবেশী ও সুদর্শন ক্লিনটন–ওবামারা বেয়াড়া বুশদের চালানো যুদ্ধের জের টেনে গেছেন। বৈশ্বিক সুশীল সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হিলারি ক্লিনটন ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে যুদ্ধবাজ আয়োজনেই ব্যস্ত ছিলেন। ট্রাম্পের বদলে তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ইরান আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যেত বলে অনেক বিশ্লেষকই সে সময় মত দেন।
সেদিক থেকে দেখলে, ট্রাম্প ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়েছেন। আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানদের শান্তি আলোচনাও হতে পারছে ট্রাম্প প্রশাসনেরই সবুজ সংকেতে। সিরিয়া থেকেও সরে আসার পথে ছিলেন ট্রাম্প। ইরান নিয়ে তম্বি করলেও হম্বি করেননি—হামলা চালাননি। ট্রাম্পের একলা চলো নীতির জন্য ইরানের অস্ত্র কেনার ওপর অবরোধের মেয়াদ শেষে হতে চললেও নতুন অবরোধে রাজি করাতে পারেননি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। ইরান এখন চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র বৈধভাবেই কিনতে পারবে। ট্রাম্পের আমলে চীনকে ঘিরে সামরিক আয়োজন চললেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নতুন কোনো যুদ্ধ চাপানো হয়নি। পুনর্নির্বাচিত যদি তিনি হনও, তখনো এই আশঙ্কা কম।
কিন্তু জাপান ও ভারত বাইডেনকে নিয়ে চিন্তিত। বাইডেনের ঘোষিত কার্যতালিকায় চীনকে সামরিকভাবে মোকাবিলার কথা নেই। জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ভারতের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা এ কথাটাই গণমাধ্যমে তুলে যাচ্ছেন। বাইডেন যদি চীনের সঙ্গে সমঝোতা করে রাশিয়ার সঙ্গে টানাটানিতে লিপ্ত হন, তাতে এশিয়ার বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা আগের মতো না–ও থাকতে পারে। ইসরায়েলের কথায় চলেও ট্রাম্প কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যকে দম ফেলার সুযোগ দিয়েছেন। বাইডেন তা না–ও করতে পারেন। এশিয়া ও পাশ্চাত্যের বন্ধুদের আশ্বস্ত করতে বাইডেন অবশ্য চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর কথা বলেছেন, বাণিজ্যে চীনকে পেছনে ফেলার কথা বলেছেন। মার্কিন পত্রিকা ফরেন পলিসির ভাষায় বললে, ‘বাইডেন হয়তো চীনের ব্যাপারে কঠোর, কিন্তু নতুন শীতলযুদ্ধ তিনি চান না।’
ট্রাম্প আমেরিকার ব্যবসায়ী লবির প্রতিনিধি। অস্ত্র কোম্পানির প্রতিনিধি তাঁকে বলা যায় না। মধ্যপ্রাচ্যে তিনি আপাতশান্তি চান, যাতে করে ইরাক–সিরিয়া এবং আফগানিস্তানে মার্কিন ঠিকাদার কোম্পানিগুলো পুনর্গঠনের ব্যবসা চালাতে পারে। তিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়ে ফিলিস্তিনে ‘উন্নয়ন’ দিতে চেয়েছিলেন। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসাতেই তাঁর আগ্রহ বেশি। হ্যাঁ, একটা যুদ্ধ তিনি করেছেন, সেটা হলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ। তাতে কিছু মার্কিনের চাকরি বেঁচেছে। এটা ঠিক, ট্রাম্প মার্কিন দেশে ব্যক্তিগত বন্দুকের অধিকার কমাতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু যুদ্ধবাজ র্যাম্বোর বদলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইমেজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কমেডিয়ানের। এবারের নির্বাচনী বিতর্কেও দেখা যায়, ইরান বা চীন কিংবা রাশিয়া অথবা মুসলিম জঙ্গিবাদ নয়, আমেরিকা ব্যস্ত তার ঘরের সমস্যা নিয়ে। বর্ণবাদ, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইত্যাদি ছিল ইস্যু।
ইতিহাস আমাদের বিভিন্নভাবে শিক্ষা দেয়। সেই শিক্ষা এই: নেতা যত শক্তিশালী হন, তত দুর্বল হয় দেশ, গণতন্ত্র নামকাওয়াস্তে হয়ে যায়। ট্রাম্প শক্তিশালী হতে গিয়ে আমেরিকাকে যে দুর্বল করেছেন, তাতে মার্কিনবিরোধীরা খুশি হতে পারেন। তবে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়া মানে আরও আরও আমেরিকান নাগরিকের বিদেশের ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত বা পঙ্গু হওয়া। ট্রাম্প সৌদি আরব ও ভারতের কাছে বিপুল অস্ত্র বিক্রির মওকা করে দেওয়ার পরও কিন্তু অস্ত্র কোম্পানিগুলোর স্পষ্ট সমর্থন তাঁর পক্ষে দেখা যায়নি। ট্রাম্পও হোয়াইট হাউসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে অস্ত্র কোম্পানির সঙ্গে জড়িত কাউকে বসাননি। যেখানে বাইডেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আছেন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের লোক।
তবে ট্রাম্পের বিজয় ভারতের জন্য খুব প্রয়োজন। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের সব পপুলিস্ট অগণতান্ত্রিক নেতাই চাইবেন, তাঁদের গোত্রের কেউই দুনিয়ার এক নম্বর পরাশক্তির ক্ষমতার আসনে বসুন। বাইডেনের জয় ভারতের বর্তমান শাসক দলের জন্য চিন্তার বিষয় হতে পারে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনসহ মার্কিন প্রগতিশীলদের সমর্থন রয়েছে বাইডেনের ওপর। তারা বাইডেন প্রশাসনকে প্রভাবিত করবে যেকোনো রকম ডানপন্থী শাসকদের ওপর চাপ তৈরি করতে। ভারত আমেরিকার বৃহত্তম অস্ত্রের বাজার, এশিয়ায় চীনকে মোকাবিলায় ভারত ও আমেরিকার পরস্পরকে দরকার। কিন্তু বাইডেনের প্রশাসন চাইবে না তাদের বড় মিত্র হোমফ্রন্টে সংখ্যালঘু নির্যাতন করে যাক কিংবা সংবিধান বদলে ধর্মীয় রাষ্ট্রের চেহারা নিক। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস বিজেপির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারেন।
ট্রাম্প শিবির বাইডেনকে ‘ওয়াকিং ডেড’ বা ‘হাঁটাচলা করা লাশ’ বলে পরিহাস করে শুধু এ কারণেই না যে তাঁর বয়স এখন প্রায় ৭৮—পরের নির্বাচনের সময় হবে ৮২, এ কারণেও যে তিনি এক মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে চান না। আমেরিকার রাজনৈতিক ঐতিহ্য মোতাবেক ধরে নেওয়া যায়, বাইডেন জিতলে পরেরবারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন কমলা হ্যারিস। আর তাঁর পেছনে থাকবেন ওবামা–পেলোসির মতো প্রভাবশালী নেতারা। শুধু ভারতীয় আমেরিকানরাই নয়, কমলাকে নিয়ে খাঁটি ভারতীয়রাও খুশি হবেন। সে কারণেও বোধ হয়, ট্রাম্প–মোদি দোস্তালি সত্ত্বেও অধিকাংশ ভারতীয় আমেরিকান বাইডেনের পক্ষে বলে জানাচ্ছে সাম্প্রতিক মার্কিন জনমত জরিপের ফল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে–ই আসুক, এশিয়ার জন্য সুখবর নেই। বাইডেনের প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে ভাবিত থাকবে, এটুকুই যা লাভ। কিন্তু আমেরিকা তখনই কোনো দেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে মাথাব্যথা করে, যদি সেই দেশটিকে তার কাবু করবার দরকার হয়। সুতরাং দিনের শেষে ট্রাম্পই জিতুন আর বাইডেন জিতুন, আদার ব্যাপারীরা শান্তির জাহাজের খবর পাবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com