ট্রাম্প ইমরান ব্যর্থ, কিন্তু আমরা সফল

হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইমরান খান। দুজনেই আজ ‘প্রাক্তন’।
ছবি: এএফপি

প্রতিষ্ঠান কেন জরুরি? একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম শর্ত কেন স্বাধীন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান? নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কতটুকু? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মূল ভিত্তি ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ কী করে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে দেখে আসা যাক কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে কী হয়েছিল।

২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে যুক্তরাষ্ট্রের খোলনলচে পাল্টে ফেলবেন তার জনতুষ্টিবাদী ডানপন্থী আদর্শ ‘ট্রাম্পিজম’ দিয়ে—এমন আশঙ্কা করেছিলেন কেউ কেউ। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে খুব লক্ষণীয় পরিবর্তন করতে পারলেও অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে মোটাদাগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের চেয়ে খুব আলাদা কিছু করতে পারেননি তিনি। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্রতিষ্ঠার অনিবার্য শর্ত, অভিবাসনবিরোধী কঠোর আইন তৈরিতে কিংবা গণবিরোধী নানা আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে কখনো তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, আবার কখনো কংগ্রেস। এখানেই ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মজা। যে কেউ চাইলেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে না।

ট্রাম্পের দিক থেকে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরির চেষ্টা হয় যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনের পর। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে যে প্রশ্ন কখনো ওঠেনি, সেই প্রশ্নই তৈরি হয়—যুক্তরাষ্ট্রে কি তবে ক্ষমতার স্বাভাবিক হস্তান্তর হবে না? নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল ট্রাম্প দফায় দফায় বলছিলেন, ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে কারচুপি করবেন এবং সেটার মাধ্যমে তাঁকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হবে, আর তেমন কিছু হলে সেটার বিরুদ্ধে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।এরপর নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করতে কিংবা নিজের পক্ষে আনতে নানাভাবে চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। বেশ কয়েকটি রাজ্যে তাঁর পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।

পেনসিলভানিয়া রাজ্যে ট্রাম্পশিবিরের মেইল ব্যালট-সংক্রান্ত মামলা খারিজ করে দেন আপিল আদালত। মিশিগানে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে করা মামলা ভিত্তিহীন জানিয়ে খারিজ করা হয়। অ্যারিজোনায় করা মামলায় পরাজয় নিশ্চিত হওয়ায় মামলা থেকে সরে আসে ট্রাম্পের দল। ট্রাম্পের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ১৬ জন ফেডারেল প্রসিকিউটরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, জালিয়াতি, অনিয়মের তথ্য উদ্‌ঘাটনের জন্য। তাঁরা সবাই লিখিত পত্রে জানিয়েছেন যে নির্বাচনে অনিয়মের কোনো ঘটনার প্রমাণ তাঁরা পাননি। এখানেও ট্রাম্প রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তাঁর পক্ষে কাজে লাগাতে পারেননি।

ট্রাম্পের নির্বাচনে জালিয়াতির প্রপাগান্ডা এরপর‌ও থামেনি। কিন্তু তাতে খুব শক্তভাবে বাধা দিয়েছে নির্বাচন পরিচালনাকারী যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ও স্টেট কর্মকর্তাদের একটি জোট। ইলেকশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গভর্নমেন্ট কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিল ও সেক্টর কো-অর্ডিনেটিং এক্সিকিউটিভ কমিটির এই জোট এক যৌথ বিবৃতিতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীদের নির্বাচন নিয়ে জালিয়াতির দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এভাবে বিচার বিভাগসহ স্বাধীন, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রাম্পের সব অপচেষ্টা ঠেকিয়ে দেয়। এটাই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের শক্তি।

জানি, অনেকেই বলবেন দীর্ঘ সময়ের গণতান্ত্রিক চর্চার দেশ আমেরিকায় প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই তো কাজ করার কথা। আমাদের এই অঞ্চলে এমন প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক। অথচ এরই মধ্যে পাকিস্তানে তৈরি হওয়া সংকট এবং সেই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা আমাদের ভিন্ন বার্তা দেয়।

৮ মার্চ ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো এক জোট হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর ইমরান খানের সরকার টিকে যাওয়া নিয়ে যতটুকু সম্ভাবনাও ছিল সেটুকুও শেষ হয়ে যায় যখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়। ইমরান পদত্যাগ করলেই হয়তো সব কূল রক্ষা হতো। কিন্তু তিনি সেটা না করে এমন এক কাজ করলেন যেটাকে প্রাথমিকভাবে অনেকে তুলনা করেছিলেন ক্রিকেটের রিভার্স সুইং কিংবা গুগলি বলের সঙ্গে।

সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবটি ডেপুটি স্পিকার যখন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দেন এবং ইমরানের আহ্বানে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন তখন ইমরান নিশ্চয়ই ভাবছিলেন সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণেই আছে। সংসদে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বিরোধী দল তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছিল এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা সর্বোচ্চ আদালতে যাবে। মজার ব্যাপার বিরোধীদের অভিযোগের ভিত্তিতে নয়, বরং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমোটো) দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যাপারে শুনানির সিদ্ধান্ত জানান।

প্রধান বিচারপতি বলেন, অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে সংসদে যা হয়েছে এবং সেটার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সবকিছুর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যটি সঠিক, কারণ যেহেতু সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে সংসদে সবকিছু ঘটেছে তাই সেটি সঠিকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে কিনা এই ব্যাপারে মতামত দেওয়ার সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। একটা গণতান্ত্রিক দেশে সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের শেষ রক্ষক।

সুপ্রিম কোর্ট তার চূড়ান্ত রায় দেওয়ার মাধ্যমে ইমরানের ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দিয়েছেন। অনাস্থা ভোট আনতে না দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি অবৈধ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এবং যেহেতু সংসদের ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাই সেই সিদ্ধান্তটিও বাতিল করে দেওয়া হয়। ৯ এপ্রিল শনিবার সংসদের অধিবেশন বসিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব এনে যত সময় লাগে সেটা নিয়ে প্রস্তাবের ভোটগ্রহণ শেষ করতে আদেশ দেয়। দিনভর নানা নাটকীয়তার পর প্রথম পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অনাস্থা ভোটে পরাস্ত হয়ে ইমরান খানকে বিদায় নিতে হলো।

পাকিস্তান দেশটিকে নিয়ে, তার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে নানারকম সমালোচনা আমাদের সমাজে আছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রেরই সর্বোচ্চ আদালত দেশের এক চরম ক্রান্তিলগ্নে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীর আজ্ঞাবহ হয়ে না থেকে তার দায়িত্ব কঠোরভাবে পালন করেছে। ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পথে যা যা হয়েছে সবই ছিল গণতান্ত্রিক চৌহদ্দির মধ্যে।

পাকিস্তানের ঘটনা পরম্পরা দেখে আমার মনে পড়ল, বাংলাদেশের গত সংসদ নির্বাচনে একটি বিদেশি সংবাদ সংস্থা ভোট শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট পেপারে ভর্তি ব্যালট বাক্স দেখিয়েছিল। কিছুদিন পরই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি সংসদীয় আসনের ওপর এক জরিপ করে জানিয়েছিল, এর ৪৭টি আসনেই নানা রকম অনিয়ম হয়েছে। এবং সেই জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ৫০টি আসনের ৩৩টি আসনেই রাতে ভোট দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

ওদিকে কেন্দ্রওয়ারি ভোটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০৩ আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ৯৬ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪১৮টি ভোটকেন্দ্রে। এ ছাড়া ৯০-৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬ হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে, ৮০-৮৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১৫ হাজার ৭১৯টি ভোটকেন্দ্রে। শুধু তা-ই নয়, অবিশ্বাস্যভাবে ৭৫ আসনে ৫৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৬টিতে সব ভোট পেয়েছে নৌকা প্রতীক ও ১টিতে পেয়েছে ধানের শীষ প্রতীক। ১ হাজার ১৭৭টি সেন্টারে বিএনপি শূন্য ভোট পেয়েছে।

নির্বাচনের নামে এই সব অবিশ্বাস্য কাণ্ডের সবই হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের নাকের ডগায়। ঘটনার সময় কিংবা ঘটনার পরে অনেক কিছু প্রকাশিত হয়ে পড়ার পরও কাউকে টু শব্দটিও করতে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রের সব অঙ্গ এবং প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি কবজা করে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ট্রাম্প, ইমরান ব্যর্থ হলেও দারুণ সফল আমরা।

  • রুমিন ফারহানা বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী