যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছিল কি না, সে-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কাউন্সেল রবার্ট ম্যুলার যখন প্রকাশ করেন, তখনই ওয়াশিংটন ডিসির অভ্যন্তরীণ কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। সেই কুৎসিত চেহারা এখন কুৎসিততর হওয়ার পথে। এখন এটি পরিষ্কার যে উইলিয়াম বার নামে যুক্তরাষ্ট্রে এমন একজন অ্যাটর্নি জেনারেল আছেন, যিনি বিশ্বাস করেন, সত্য-মিথ্যা যা-ই থাক, প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করাই তাঁর একমাত্র কাজ। গত সপ্তাহে সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা উইলিয়াম বার একের পর এক মিথ্যা এবং আদালত অবমাননাকর কথা বলে গেছেন।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় উইলিয়াম বার ১৯৮০-এর দশকের ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেই ঘটনা যাঁদের মনে আছে তাঁদের পক্ষে উইলিয়াম বারকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘চৌকিদার’ মনে
করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বারের নিজের লেখা ১৯ পৃষ্ঠার নথি থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাফাই গেয়ে বলেছেন, ট্রাম্প কখনোই ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াননি। ওই নথিতে তিনি বিশেষ কাউন্সেল রবার্ট ম্যুলারের তদন্তকে ‘ভয়ানক ত্রুটিপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওই নথি বিশ্লেষণে বোঝা যায়, উইলিয়াম বার মনে করেন প্রেসিডেন্ট যদি তাঁর নিজের বিষয়ে তদন্ত চালানোকে অন্যায্য কাজ বলে মনে করেন, তাহলে সেই তদন্ত ঠেকিয়ে দেওয়ার আইনি ও নৈতিক বৈধতা তাঁর রয়েছে।
নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি থাকাকালে উইলিয়াম বার ট্রাম্পকে বিভিন্ন সময় আইনের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন। রাশিয়ার হস্তক্ষেপের তদন্ত থেকে বাঁচতে এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে ট্রাম্প জেফ সেশনসের ওপর খাপ্পা হয়েছিলেন এবং তার জের ধরে তাঁকে সরিয়েও দেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা দুরস্ত হবে কি না, সে বিষয়ে ম্যুলার নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে তা কংগ্রেসের হাতে ছেড়ে দেন। কিন্তু উইলিয়াম বার হুট করেই প্রেক্ষাপটে ঢুকে পড়েন এবং ট্রাম্পকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করা শুরু করেন। গত মার্চে তিনি কংগ্রেসকে চিঠি দিয়ে প্রথম এই দাবি করেন এবং পরে সংবাদ সম্মেলন করে সেখানে ৯০ মিনিট কথা বলে ট্রাম্পের পক্ষে কথা বলেন। এরপর সিনেটে দেওয়া সাক্ষ্যেও তিনি একই কথা বলেন।
স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির বক্তব্য থেকে জানা গেল, উইলিয়াম বার কংগ্রেসে মিথ্যা কথা বলেছেন। রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার কংগ্রেসে উপস্থাপন করেছিলেন রবার্ট ম্যুলার। এই সারসংক্ষেপ লিখে দেন উইলিয়াম বার। কিন্তু কংগ্রেসে হাজির হয়ে উইলিয়াম বার বলেছেন, তিনি ওই সারসংক্ষেপ লেখেননি। তিনি বলেন, ‘এটি হয়তো আমার কোনো কর্মচারী লিখে থাকতে পারেন।’ পেলোসি এই মিথ্যা বলাকে ‘অপরাধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এখন ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব আনবে কি না, তা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত সে সম্ভাবনা খুবই কম দেখা যাচ্ছে। খোদ ডেমোক্র্যাট নেতা ও স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিই এ ধরনের উদ্যোগের পক্ষে নন। তাঁর যুক্তি হলো, সিনেট এখনো রিপাবলিকানদের দখলে। সে কারণে এ ধরনের প্রস্তাব উঠলে তা শেষ পর্যন্ত অবধারিতভাবেই বাতিল হয়ে যাবে। এতে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার বদলে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে তিনি মনে করেন, আগামী ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করতে হবে—এই লক্ষ্য নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের এগিয়ে যেতে হবে। ন্যান্সি পেলোসি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ট্রাম্পকে সুস্পষ্টভাবে পরাজিত করতে না পারলে এমনও হতে পারে তিনি ফল ঘোষণার পরও ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেন না। কোনো রকম বিতর্কিত ফলের মধ্য দিয়ে যদি তিনি টিকে যান তাহলে তাঁর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ট্রাম্প তখন বেপরোয়া দানবের মতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন।
অর্থাৎ আর যা-ই হোক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ট্রাম্পের সামনে খুব বড় কোনো হুমকি নেই। বোঝা যাচ্ছে আগামী এক বছর ট্রাম্প তাঁর বিরুদ্ধে শুধু রুশ সংযোগ নয়, এর বাইরেও সব ধরনের তদন্ত তিনি ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। কয়েক দশকের মধ্যে তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি তাঁর আয়কর বিবরণী প্রকাশ করেননি। তাঁর পারিবারিক ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক বিষয়ই তাঁর পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে যখনই তদন্তের কথা উঠছে, তখনই ট্রাম্প সে উদ্যোগ ঘুরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করছেন।
সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া যাতে তাঁকে সহায়তা করতে পারে, তিনি সেই দরজা খুলে রাখছেন। মার্কিন নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ রুখে দেওয়াসংক্রান্ত একটি বিল হোয়াইট হাউস এবং কংগ্রেসের রিপাবলিকান নেতারা আটকে দিয়েছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার এখন ট্রাম্পের গলফ খেলার সাথি ও সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির প্রধান লিন্ডসে গ্রাহামের সঙ্গে একজোট হয়ে নতুন প্রোপাগান্ডায় নেমেছেন। তাঁরা এখন বলা শুরু করেছেন, ট্রাম্পের রুশ–সংযোগ নিয়ে যেসব কথা উঠেছে তা আসলে হিলারি ক্লিনটনের লোকজনের অপপ্রচার। এ অভিযোগকে বার এখন ‘উইচ হান্ট’ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রচারণায় নেমেছেন।
এফবিআইয়ের বর্তমান এবং সাবেক অনেক কর্মকর্তা ট্রাম্পের রুশ–সংযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার পক্ষে ছিলেন। তাঁরা সবাই এখন নতুন করে ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তু হবেন। ম্যুলারের প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে বলেছেন, রুশরা ২০২০ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। শুধু এই মন্তব্যের জন্যও ক্রিস্টোফারকে খেসারত দিতে হতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস আগাগোড়া দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা বেপরোয়া হয়ে গেছেন। ট্রাম্প এখন নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছেন। তাঁর এই ভাবনা তাঁকে ভয়ানক হিংস্র করে তুলবে। এর কারণে শিগগিরই বহু নিরীহ মানুষকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
এলিজাবেথ ড্র্যু ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক