ট্রাম্পের মরণকামড়ের গভীরে কী আছে

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

ঠিক এভাবেই হিটলার দলবল নিয়ে জার্মান রাইখস্ট্যাগ আক্রমণ করেছিলেন, ঠিক এভাবেই কিন্তু ফরাসি বিপ্লবীরা নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ বিপ্লব না প্রতিবিপ্লব, তা বলার জন্য আরও সময় দরকার। আপাতত বলা যায়, মাফিয়া ক্ষমতা রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কাছে পরাজিত হলো। তবে যারা বিশ্বাস করে ট্রাম্পকে বেআইনিভাবে কারচুপি করে হারানো হয়েছে, তারা যেকোনো কিছু করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি আব্রাহাম লিংকন ক্যাপিটল হিলকে দুবার রক্ষণশীলদের সামরিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন। রক্ষণশীলদের পতাকা সেখানে আর ওড়েনি। কিন্তু ক্যাপিটল হিলে মার্কিন কংগ্রেস ভবনে এবার সেই পতাকা উড়ল। বিক্ষোভকারীরা নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে, তা করতে পারল কয়েক ঘণ্টার জন্য। আব্রাহাম লিংকনের কথাটাই সত্যের কাছাকাছি বলে দেখা গেল। ১৮৩৮ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘…(বিপদ) যদি এসে পড়ে, তবে তা আসবে আমাদের ভেতর থেকে। এটা বাইরে থেকে আসতে পারবে না। যদি ধ্বংসই আমাদের নিয়তি হয়, আমরাই হব তার রচয়িতা ও সম্পন্নকারী। মুক্ত মানুষের দেশ হিসেবে আমরা হয় চিরকাল থাকব, নয়তো আত্মহত্যা করব।’
ক্যাপিটল হিলে জনতার হামলার ঘটনায় পুলিশের গুলিতে নিহত নারীটি মার্কিন গণতন্ত্রের সেই পূর্বকথিত আত্মহত্যাচেষ্টার প্রতীক হয়ে থাকবেন।

ক্যাপিটল হিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক আবাসিক এলাকা। সেখানেই কংগ্রেস ভবন মার্কিন গণতন্ত্রের সৌধ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ৬ জানুয়ারি আক্রান্ত হয়েছে সেটাই। যখন বিজয়ী ঘোষিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্ষমতায়নের বৈধতা দেওয়া হচ্ছিল, তখন ট্রাম্পপন্থী জনতা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেখানে হামলে পড়ে। কংগ্রেসম্যানরা পালাতে বাধ্য হন। লিংকন কথিত মার্কিন গণতন্ত্রের আত্মহত্যার ব্যর্থ মহড়া দুনিয়া দেখল। আর সেটা ঘটল সেই দিন, ঠিক এক বছর আগে যেদিন আমেরিকা ইরাকে ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান হাজি কাশেম সোলাইমানিকে ড্রোন হামলা করে হত্যা করেছিল।

এভাবে পার্লামেন্ট ভবনে বিদ্রোহী জনতার হামলার ঘটনা যদি ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে ঘটত কিংবা ঘটত ইরানে বা তুরস্কে, তাহলে মার্কিন প্রশাসন তাদের অভিনন্দন জানাত। অনেক মার্কিনবিরোধী মানুষ এখন তেমন করেই সন্তোষ জানাচ্ছেন। কিন্তু ঘটনাটা আরও গভীর।

পৃথিবীর সবচেয়ে সুসংগঠিত রাষ্ট্রে আইনের শাসন যে কতটা ঠুনকো, কত বিভক্ত সেখানকার রাজনীতি এবং দেশটা যে গৃহযুদ্ধের কতটা কিনারে, ক্যাপিটল হিল–কাণ্ড তা দেখিয়ে দিল।

টুইন টাওয়ারের ঘটনা যেমন আমেরিকাকে বদলে দিয়েছিল, বদলে দিয়েছিল দুনিয়ার স্থিতিশীলতাকে, ক্যাপিটল হিলের নৈরাজ্য তেমন আরেকটা ঘটনা, যার আগের আর পরের পরিস্থিতি আর এক থাকবে না।

এর ইঙ্গিতই কি অনেকে দিয়ে যাচ্ছিল না? হলিউডি সিনেমা ডার্ক নাইট-এ একবার, তারপর সাম্প্রতিক জোকার সিনেমায় কি এমন দৃশ্য আমরা দেখিনি? উন্মত্ত জনতা সব শৃঙ্খলা ভেঙে দিচ্ছে, জনতা এলিটদের আক্রমণ করছে। উদ্দেশ্যহীন তাণ্ডবে আমেরিকা ভেসে যাচ্ছে। এর মধ্যে নাচছে তাদের নেতা, উন্মাদ কিংবা ভাঁড়ের ছদ্মবেশে থাকা এক নৈরাজ্যবাদী। সেই চরিত্র, ডার্ক নাইট বলছে, ‘সামান্য নৈরাজ্য আরম্ভ করো, কায়েমি ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দাও, দেখবে সবকিছু ভেঙে পড়বে। আমি নৈরাজ্যের প্রতিনিধি...জানো তো, উন্মত্ততা হলো মাধ্যাকর্ষের মতো, এর জন্য শুধু দরকার সামান্য একটা ধাক্কা...।’

টুইন টাওয়ারের ঘটনা যেমন আমেরিকাকে বদলে দিয়েছিল, বদলে দিয়েছিল দুনিয়ার স্থিতিশীলতাকে, ক্যাপিটল হিলের নৈরাজ্য তেমন আরেকটা ঘটনা, যার আগের আর পরের পরিস্থিতি আর এক থাকবে না। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র যেমন তার ভেতরে টুইন টাওয়ারের ঘটনা ঠেকাতে পারেনি (অনেকে বলেন ঘটনাটা ঘটতে দেওয়া হয়েছিল), তেমনি বিশ্বের সেরা গণতন্ত্রের সেরা পীঠস্থান ক্যাপিটল হিল এক বেলার জন্য বেদখল হওয়াও ঠেকাতে পারেনি আমেরিকার গণতন্ত্র, আমেরিকার প্রশাসন। অনেকে বলছেন, এটাও ঘটতে দেওয়া হয়েছে। ঘটতে দেওয়া হয়েছে যাতে ট্রাম্পকে অভিশংসন করা যায়, যাতে তাঁকে আর এক দিনের জন্যও প্রেসিডেন্ট থাকতে না দেওয়া হয়, যাতে চিরতরে ট্রাম্পের রাজনীতির কবর দেওয়া যায়, যাতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষিত হন এবং যাতে গত নভেম্বরের নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ ট্রাম্প করে যাচ্ছেন, তাকে আরও হাস্যকর ও ঘৃণিত বলে দেখানো সম্ভব হয়।

এতে করে মার্কিন রাজনীতির বিভাজন আরও সহিংসতার দিকেই যেতে পারে। অনেক সুশীল ট্রাম্প সমর্থক এখন বাইডেন শিবিরে, তথা ডেমোক্র্যাট শিবিরে ভিড়ছে। কিন্তু হতাশ ও ক্ষুব্ধ ট্রাম্পপন্থীরা আরও মরিয়া হচ্ছেন। কংগ্রেস ও সিনেটে রিপাবলিকানরা আরও দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে বাইডেন এমন একচেটিয়া ক্ষমতা উপভোগ করবেন, যা ট্রাম্পও করতে পারেননি। এর অর্থ আমেরিকার রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। তা যদি হয়, তাহলে মেরুকরণ আরও বাড়বে। নিচুতলায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বিগত নির্বাচন। এবারে তিনি ভোট পেয়েছিলেন আগেরবারের চেয়ে বেশি। এরা হারিয়ে যাবে না। ট্রাম্প ভীরু ও লাজুক মানুষদের জাগিয়ে দিয়েছেন। সুপ্ত ঘৃণাবাদীরা এখন আরও সাহসী। ট্রাম্প চলে গেলেও এরা থেকে যাবে।

অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে ডেমোক্র্যাটরা যুদ্ধবাজ বলে পরিচিত। তাদের আমলেই আমেরিকা বেশি আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি বেছে নেয়। উপরন্তু, নতুন প্রশাসনে একজনও প্রগতিশীল মন্ত্রী নেই। ট্রাম্প চলে গেলেও জলে কুমির ডাঙায় বাঘ অবস্থা থেকে না আমেরিকা, না পৃথিবী, কেউ ‍মুক্তি পাবে।

ট্রাম্প আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজকে ঘোলা পানিতে টেনে নামিয়েছিলেন, ক্যাপিটল হিলের ঘটনায় তিনি দেশটাকে বিপজ্জনক দরিয়ায় ঠেলে দিলেন।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।