ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও টিভি নাটক প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কয়েকটি দাবি তুলেছেন। ১. বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন (স্পনসর) ভারতের টিভি চ্যানেলে প্রচার হতে পারবে না। বাংলাদেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠানকেই সহযোগিতা করতে হবে। ২. বিদেশি টিভির কোনো সিরিয়াল বাংলা ভাষায় ডাব করে প্রচার করা যাবে না। ৩. বাংলাদেশের কোনো টিভি অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপনে বিদেশি শিল্পী বা মডেল ব্যবহার করা যাবে না ইত্যাদি।
দাবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তাই আলোচনার দাবি রাখে। প্রায়ই আমরা দেখছি বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কলকাতার কয়েকটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে স্পনসর করছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মালিক বা অনুষ্ঠাননির্মাতারা এটা ভালো চোখে দেখছেন না। না দেখাটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞাপন বা স্পনসরের এই টাকা বাংলাদেশে থাকলে ঢাকার নির্মাতাদের অনেক নাটক ও অনুষ্ঠানের স্পনসর পাওয়া যেত। প্রতিটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বা স্পনসরের একটা বাজেট থাকে। বাজেটের একটা বড় অংশ যদি ভারতে চলে যায়, তাহলে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল ও নির্মাতারা বঞ্চিত হন।
সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বিদেশে (ভারত নয়) তৈরি সিরিয়াল বাংলা ভাষায় ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছে। সে রকম একটি সিরিয়াল বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিভিন্ন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও অনুষ্ঠাননির্মাতারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের দাবি, বিদেশে তৈরি ও বাংলা ভাষায় ডাবিং করা সিরিয়াল বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে প্রচার করা যাবে না। তাঁদের বক্তব্য, এ ধরনের সিরিয়াল বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে প্রচার (এবং পুনঃপ্রচার) করা হলে বাংলাদেশের নাটক প্রচার করার আর সুযোগ পাওয়া যায় না।
এটাও খুব যুক্তিসংগত দাবি। কারণ, বর্তমানে টিভি নাটক নির্মাণ একটা বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বহু লেখক, পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মী এই ব্যবসায় যুক্ত। এটা তাঁদের পেশা। টিভি নাটকের আয় থেকে লক্ষাধিক মানুষের সংসার চলছে। তাই এই শিল্পী বা ব্যবসাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
আরেকটি দাবি, দেশের টেলিভিশন শিল্পে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবৈধভাবে কাজ করা বন্ধ করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে কাজ করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই দাবিগুলো পূরণ করবে কে? আরেকটি প্রশ্ন হলো, টিভি চ্যানেল ও টিভি অনুষ্ঠান তৈরির সঙ্গে শুধু দুটি পক্ষই যুক্ত নয়। আরেকটি পক্ষ রয়েছে। তাঁরা হলেন দর্শক। টিভি নিয়ে আমরা যত কথাই বলি না কেন, আসল পক্ষ হলেন দর্শক। তাঁদের জন্যই টিভি চ্যানেল, তাঁদের জন্যই টিভি অনুষ্ঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দর্শকদের কোনো ফোরাম নেই। ফলে দর্শকদের দাবি বা বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারলে চ্যানেল ও নির্মাতাদের দাবিগুলোর প্রতি সুবিচার করা সহজ হতো। এখন সেই সুযোগ নেই। এখন সরকার যে নীতিই গ্রহণ করুক না কেন তা একতরফা নীতি হবে। কারণ, সরকারকে দর্শকদের বক্তব্য ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। সরকার যেমন চলচ্চিত্র নির্মাতাগোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি (বিশেষ করে ভারতীয়) ছায়াছবি আমদানির ব্যাপারে নীতি গ্রহণ করেছে। চলচ্চিত্র দর্শকদের কথা বিবেচনা করেনি।
বাংলাদেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কলকাতার টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বা স্পনসর করবে কি করবে না, তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তাদের প্রোডাক্ট যদি ভারতে বিক্রি হয় তাহলে ব্যবসার স্বার্থে তারা বিজ্ঞাপন ও স্পনসর করতেই পারে। তাদের ব্যবসা যদি ভারতে সম্প্রসারিত হয় আমাদের খুশি হওয়া উচিত। ভারত বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করছে বলে অনেকে ক্ষুব্ধ। আমাদের দেখতে হবে ব্যবসায়ীরা অবৈধ পথে টাকা পাচার করছেন কি না। তাঁরা যদি সরকারের অনুমতি নিয়ে সরকারি চ্যানেলে টাকা আদান-প্রদান করেন, তাহলে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেই অনুষ্ঠানেই স্পনসর করবে, যে অনুষ্ঠান দর্শকেরা দেখেন। যে অনুষ্ঠান বা নাটকের দর্শক কম সেই অনুষ্ঠানে কেন স্পনসর করতে যাবে? কলকাতার টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান স্পনসর করা নিয়ে কোনো আপত্তি তোলা উচিত হবে না। তা ছাড়া এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের টিভিতেও অনেক বিজ্ঞাপন দেয় ও অনেক অনুষ্ঠান স্পনসর করে।
বিদেশে তৈরি সিরিয়াল বাংলা ভাষায় ডাবিং করে প্রচার করাটা কোনো দোষের কিছু নয়। কারণ এর ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে নতুন কিছু যুক্ত হচ্ছে। দেখতে হবে বিদেশি সিরিয়াল কোনো অপসংস্কৃতির প্রচার করছে কি না। দেশি হোক বিদেশি হোক, বাংলা হোক আর হিন্দি হোক, কোনো অপসংস্কৃতির প্রচার আমরা মেনে নিতে পারি না। টিভি অনুষ্ঠাননির্মাতারা কোনো অপসংস্কৃতি প্রচারের অভিযোগ তুললে তথ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চয় তা আমলে নেবে।
বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের সরকারের অনুমতি ও নিবন্ধন ছাড়া কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নীতি থাকা দরকার।
আমাদের টিভি নাটক বা অনুষ্ঠানের সমস্যা ভিন্ন জায়গায়। আমাদের নাটকে এত বিজ্ঞাপন বিরতি থাকে যে দর্শক অনুষ্ঠান দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেক দর্শক পরে ইউটিউবে নাটক দেখেন। নাটকে বা অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনের সময় অনেক কমিয়ে ও বিজ্ঞাপনের রেট বাড়িয়ে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ একটা সমঝোতায় আসতে পারে। বেশি বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার হলো, কিন্তু দর্শক সেই নাটক দেখলেন না, তাতে বিজ্ঞাপনদাতার কী লাভ হলো? স্পনসর ও বিজ্ঞাপনদাতাদের এটা বুঝতে হবে। কলকাতার টিভি অনুষ্ঠানে ঘন ঘন বিজ্ঞাপন বিরতি থাকে না। ফলে দর্শক আটকে থাকেন।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ‘পে চ্যানেল’ প্রবর্তন করা যায় কি না, ভেবে দেখা যায়। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ দর্শকের মাসিক ফি নিয়ে চ্যানেল চালাবে। বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়। মানসম্পন্ন চ্যানেলগুলো সহজেই দর্শক ফির ওপর নির্ভর করতে পারে। কোনো দর্শকই ৩৫টি টিভি চ্যানেল দেখেন না। যেসব চ্যানেল তিনি দেখতে চান শুধু সেগুলোই তিনি ভাড়া নেবেন। পয়সা দেবেন। ‘পে চ্যানেল’ হলে টিভি কর্তৃপক্ষ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচারের একটা সুযোগ পাবে। যে চ্যানেল সব সময় সুনির্বাচিত ও মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করবে, তার মাসিক ফিও বেশি হবে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তখন বেশি দাম দিয়ে ভালো অনুষ্ঠান ক্রয় করতে অনুপ্রাণিত হবে। অনুষ্ঠান ক্রয়ে তেল আর ঘির এক দাম হবে না। ‘পে চ্যানেল’-এর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত। তবে অবশ্যই এ ব্যাপারে একটি সরকারি নীতিমালা থাকতে হবে।
দর্শক ভালো অনুষ্ঠান দেখতে চান। তা ঢাকার হোক বা কলকাতারই হোক। এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করা চলে না। বাংলাদেশের নির্মাতারা ভালো নাটক বা সিরিয়াল তৈরি করলে দর্শকেরা অবশ্যই দেখবেন। এখনো দেখছেন। এ দেশে ভালো নাটক বা সিরিয়াল তৈরি বা প্রচার না হলে দর্শক দেখবেন কেন? কলকাতার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত দুর্বল অনুষ্ঠান তো এখানকার দর্শক দেখেন না। কয়েকটি চ্যানেলের ভালো অনুষ্ঠান বা সিরিয়ালই শুধু দেখেন। দর্শক বা পাঠক একটি স্বাধীন গোষ্ঠী। তাঁকে কোনো সরকারি নীতি বা দেশপ্রেমের বুলি দিয়ে আটকানো যাবে না।
>পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল এখনো দেখা যায় না। এটা আমাদের সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। অন্তত কলকাতায় যদি বাংলাদেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেল দেখা যেত, পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো
বর্তমান বিশ্বায়নের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সৃজনশীল কোনো কিছু বন্ধ করার দাবি তোলা হাস্যকর। কোনো সচেতন ও শিক্ষিত লোকের এ রকম দাবি করা উচিত নয়। বিদেশি ছবি বন্ধ করার আবদার মেটাতে গিয়ে আজ ঢাকার চলচ্চিত্র কোথায় নেমে গেছে তা একবার দেখুন। শিল্পসাহিত্যকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই টিকতে হবে। কোনো কিছু বন্ধ করে নয়। হুমায়ূন আহমেদ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা কখনো ভারতীয় বই আমদানির বিরুদ্ধে কথা বলেননি। কারণ, আমাদের সাহিত্যিকদের আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও সেই আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
টিভি ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে সবাই কাজ করতে পারেন না। এই দুটি মাধ্যম উচ্চ প্রতিভাবানদের জন্য। এগুলো অত্যন্ত সৃজনশীল মাধ্যম। অনেক লোককে এই মাধ্যমে কাজ করে সংসার চালাতে হবে, এমন আশা করা উচিত নয়। বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। আমাদের দেশে ব্যবসা কম। শিল্পকারখানা আরও কম। তাই স্পনসরও কম। বেশির ভাগই গরিব স্পনসর। স্পনসর, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন এজেন্সির মধ্যে শিক্ষিত, রুচিমান, দেশপ্রেমিক ব্যক্তির সংখ্যাও কম। এর মধ্যে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী দাঁড়িয়ে গেছে। ভালো নাটক, ভালো অনুষ্ঠান, সুস্থ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের স্পনসর পাওয়া কঠিন। কলকাতার টিভিতে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে যা ‘পুরস্কার’ দেওয়া হয়, আমাদের অনেক অনুষ্ঠানের পুরো বাজেট অনেক সময় তার চেয়ে কম।
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল এখনো দেখা যায় না। এটা আমাদের সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। অন্তত কলকাতায় যদি বাংলাদেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেল দেখা যেত, পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো। আমাদের দেশের অনেক প্রতিভাকে কলকাতার দর্শকেরা চিনতেন। এতে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা বাড়ত। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের টিভি চ্যানেল দেখানোর দাবিতে এ দেশের শিল্পীরা কোনো আন্দোলন করলেন না, এটা দুঃখজনক।
টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতারা যে দাবি তুলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। টিভি মিডিয়ার সামগ্রিক সমস্যাগুলো নিয়ে তথ্যমন্ত্রী একটি আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারেন। যেখানে সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।