এই অতিমারি থেকে রক্ষা পেতে হলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জনগণকে টিকা দিতে হবে। এ জন্য লাগবে ২৫ কোটি ডোজ টিকা। বহুপক্ষীয় উদ্যোগ কোভ্যাক্সের বাইরে আর একটিমাত্র উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট তিন কোটি ডোজ টিকা দেবে। তার মধ্যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসেছে মাত্র ৭০ লাখ টিকা। প্রতি মাসে ৫০ লাখ টিকা পাঠানোর কথা ছিল। এ ছাড়া ভারত ৩২ লাখ ডোজ টিকা উপহার দিয়েছে। ভারত নিজেই এখন ভয়ংকর সংক্রমণে আক্রান্ত, ফলে ২৫ মার্চ থেকে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে তারা। কোভ্যাক্স থেকেও কোনো ডোজ এখন পর্যন্ত আসেনি। ২৬ এপ্রিল থেকে তাই টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ।
২৮ নভেম্বর এ কলামেই ‘সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে’ শীর্ষক নিবন্ধে টিকার নিজস্ব উৎপাদন, বহুপক্ষীয় সঠিক ভাগ, সমন্বিত বিতরণজাল গঠনসহ বহুমুখী একটি উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
এককেন্দ্রিক নির্ভরতা
ভারতে সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং চুক্তি অনুযায়ী টিকা রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের মারাত্মক পরিস্থিতির কারণে ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ আপাতত চুক্তি অনুযায়ী টিকা পাচ্ছে না। কূটনৈতিক চাপ বা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে টিকা আদায়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও সঠিক সময়ে পুরো সরবরাহ নিশ্চিত করার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। টিকার কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত চাহিদা অনুযায়ী টিকা উৎপাদন করতে পারছে না। উপরন্তু কোম্পানিটি তহবিল ঘাটতির কথা বলছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদনের অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তা করছে আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ভারতের নিজের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি চুক্তি মোতাবেক কোভ্যাক্সের জন্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে কি না, তাই নিয়ে সংশয় রয়েছে। একটিমাত্র উৎসের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করাটা সমীচীন হয়নি।
শুরুর দিকে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও চাপে পড়ে বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে সরকার টিকার বিকল্প উৎসে যেতে পারেনি। এখন রাশিয়ার সঙ্গে টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পেতে একটি ‘গোপনীয়তা’র চুক্তি করেছে। এখন সমন্বিত দর-কষাকষির মাধ্যমে সামগ্রিক একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। প্রথমত, চুক্তিটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে পারস্পরিক আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে তিনটি বিকল্পেরই উল্লেখ থাকতে হবে। টিকার সরাসরি আমদানি, বিপুল পরিমাণ বা বাল্ক আমদানি করে এখানে বোতলজাত করা এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে দেশে উৎপাদন করা। তৃতীয়ত, এতে বহুমাত্রিকতা থাকতে হবে, যাতে সব উৎস থেকেই প্রয়োজনীয় ডোজ টিকা সংগ্রহ করা যায়। সরকারিভাবেই যৌথ উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে টিকার অনুমোদন দেওয়ারও ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে মান ঠিক রাখতে হবে, যাতে জনগণের ওপর ঝুঁকি না পড়ে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) চীনা কোম্পানি সিনোভেকের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) আবেদন করেছিল। এ উদ্যোগ কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তা নিয়ে সরকারি কোনো ভাষ্য জনগণ পায়নি। আবার চীনের সঙ্গেও টিকা নিয়ে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। চীনা প্ল্যাটফর্ম ‘ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’য় বাংলাদেশ ছাড়াও আছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। টিকা প্রদান জরুরি মানবিক জনস্বাস্থ্যের বিষয়। এর সঙ্গে ভূ–রাজনীতি গুলিয়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তেমনি আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়; শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলা জরুরি।
বহুপক্ষীয় ন্যায্যতা
বিশ্বজুড়ে টিকার সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টনের জন্য গত বছরের মাঝামাঝি কোভ্যাক্স কর্মসূচি শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চলতি বছরের মধ্যে প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ২০ শতাংশের জন্য টিকার সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় আগামী মের মধ্যে যে পরিমাণ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহের কথা ছিল, এ পর্যন্ত তার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ সরবরাহ সম্ভব হয়েছে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় দেশগুলো মে পর্যন্ত অঙ্গীকৃত টিকার মাত্র এক-দশমাংশ পেয়েছে। বাংলাদেশ, মেক্সিকো, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশ এক ডোজ টিকাও পায়নি। আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা পেয়েছে বরাদ্দের মাত্র ৩২ শতাংশ; নাইজার, কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো পেয়েছে বরাদ্দের ২৮ শতাংশ টিকা। বহুপক্ষীয় ন্যায্যতার লক্ষ্যে ধনী দেশগুলোর মজুত টিকা কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে প্রদানের ন্যায়সংগত দাবি তোলার সময় এসেছে। মূলত উৎপাদক দেশগুলোর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং ধনী দেশগুলোর মজুতের কারণে কোভ্যাক্স টিকা সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আবার টিকার মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত নয় বলে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেরাও উৎপাদনে যেতে পারছে না। মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করা গেলে এ বছরের মধ্যেই বিশ্বের ৬০ ভাগ মানুষ এবং ২০২২ সালের মধ্যে সবাইকে এই টিকা দেওয়া সম্ভব।
ঐকমত্য আছে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো আগে টিকা পাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত কাঠামো অনুযায়ী সুষম বণ্টন ঠিক করা হবে। কিন্তু ধনী দেশগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাঠামো মানতে অনিচ্ছুক। টিকার জোট গ্যাভি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া ব্যবস্থা বন্ধের কোনো শর্ত জুড়ে দিতে পারেনি। টিকার সুষম বণ্টনের কথা বলা হলেও উৎপাদন, সরবরাহ, দাম নির্ধারণ এবং ন্যায়সংগত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে গ্যাভি। কোম্পানিগুলো একচেটিয়া দাম নির্ধারণ করছে। কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে জনগণের অর্থে আবিষ্কার করা টিকা জনগণের সম্পদ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনেক দাম দিয়ে টিকা কিনতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত থেকে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে বেশি দামে টিকা কিনছে। আবার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্রয় করা টিকাও যথা সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না।
কাজের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন বলেছে, বিশ্ব মঞ্চে তারা নেতৃত্বের আসনে ফিরে এসেছে—‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’! ২২ ও ২৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত শীর্ষনেতাদের জলবায়ু সম্মেলনে তার কিছুটা আঁচ পড়েছে। জি-৭ সম্মেলনে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে তারা কী করবে, সেদিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এখনো আগের মতোই টিকার মেধাস্বত্ব উন্মুক্তের বিরোধিতা করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অনুসারী ইউরোপীয় দেশগুলো টিকার গণ–উৎপাদন ঠেকিয়ে রেখেছে। গণস্বাক্ষরসহ বিভিন্ন জন–আন্দোলন সত্বেও আজতক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া ব্যবসাকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছে। অথচ করোনার টিকা একটি গণদ্রব্য। উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল।
এককেন্দ্রিকতা থেকে সক্ষমতা
১০ বছর আগেও মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট জলাতঙ্ক রোগের টিকা উৎপাদনে সক্ষম ছিল। বিদেশ থেকে টিকা এনে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অবহেলা, অদূরদর্শিতা, অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির টিকা উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ করোনা অতিমারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে টিকা উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা কত প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আরও যাচাই-বাছাই করে নিজেরাই উৎপাদনে যেতে হবে। সবার জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে নিজস্ব উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’–এর চেয়ারপারসন
rt@du.ac.bd