টাকার মান কমলে জাতির মান কমে না

ছবি: সংগৃহীত

১ ডলারের বাজারদাম ১০০ টাকা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের নীতিমহলে হইচই পড়ে গেছে। মাত্র কদিন আগেই ডলারের বাজারদাম ৯০ টাকার নিচে ছিল। টান পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে। ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত জমানো ৪৮ বিলিয়ন ডলার মে মাসে ৪২ বিলিয়নের কাছাকাছি এসে নেমেছে। দ্রুত হারে বাড়ছে আমদানি। রপ্তানি ও প্রবাসীদের মুদ্রা প্রেরণ বা রেমিট্যান্স আমদানির গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না, যা চলতি হিসাবের ঘাটতি আরও বাড়ার হুমকি দিচ্ছে। জুলাই পর্যন্ত তা ১৭ বিলিয়ন ডলারে ঠেকতে পারে। এতে রিজার্ভ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা। সব মিলিয়ে ভীতি ঊর্ধ্বমুখী।

কেন এমন হলো? এটি আসলে বাজারকে অগ্রাহ্য করার শাস্তি। অর্থনীতির দুই দ্বিমুখী শক্তির নাম চাহিদা ও জোগান। এদের মুখোমুখি ধাক্কায় প্রতিটি জিনিসের মূল্য নির্ধারিত হয়। একটা দেশের মুদ্রার দামও সেভাবে নির্ধারণ না করলে জাতিকে তার খেসারত দিতে হয়। এটি বাজার অর্থনীতির মূল কথা। অর্থনীতি সে খেসারত দিচ্ছে এবং আরও দেবে যত দিন পর্যন্ত জ্ঞান, বুদ্ধি ও গবেষণা অগ্রাহ্য করে কর্তাব্যক্তিরা ‘গায়ের জোরে’ নীতি বানাবেন। অর্থনীতির তত্ত্বকে উপেক্ষা করে নীতি বানানো নির্বুদ্ধিতা। সেগুলো স্বল্পমেয়াদি রাজনীতিতে লোভনীয় হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনে।

ডলারের বিপরীতে টাকার উচ্চমূল্য ধরে রাখা হয়েছে ২০১০ দশকের প্রায় মধ্যকাল থেকেই। ধরা যাক, খোলাবাজারে ডলারের দাম ৯০ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেটিকে ৮৫ টাকায় ধরে রাখল। এই পরিস্থিতির নাম বিনিময়ের হার উচ্চ করে রাখা—কিংবা ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কৃত্রিমভাবে উচ্চ করে রাখা—টাকার মান পড়তে না দেওয়া। ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রয়ক্ষমতা আসলে কমে গেছে। কিন্তু বাজার সংকেত উপেক্ষা করে তাকে কমতে না দেওয়া। অনেকটা স্টেরয়েড খাইয়ে কমজোর দৌড়বিদকে ম্যারাথনে নামানোর মতো।

কোনো মান্ধাতা মস্তিষ্কের উপদেষ্টার কথা শুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর যখন এ কাজ করেন—এবং করে গেছেন ছয় বছর ধরে—তখন মন্ত্রিমহলে তাঁকে ‘হিরো’ হিসেবে দেখা হয়। কী অদ্ভুত ক্ষমতায় জাতীয় টাকার মান ধরে রেখেছেন ইনি! আসলে এটা ধরে রাখা নয়; এর নাম টাকার সঠিক মূল্য না জানা কিংবা নির্ধারণ থেকে পিছিয়ে পড়া। গবেষণা ও তত্ত্বজ্ঞানের অভাবে কোনো কিছু না করা। এ ধরনের অনড়তার মধ্যে কেউ কেউ বীরত্ব খুঁজে পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা নির্বুদ্ধিতার সাক্ষ্য বহন করে।

টাকার মান কমলে জাতির মান কমে না; বরং উন্নয়নশীল একটা জাতির ক্ষমতা বাড়ে। কারণ, এতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ে, আমদানি কমে, চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে, বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল আরও মোটাতাজা হয়। অর্থনীতির এ শিক্ষা অনেক রাজনীতিক মহলে নেই। অনেক মন্ত্রী টাকার মান না কমানোর জন্য গভর্নরের দিকে পারলে ফুল-চন্দন ছুড়ে দেন—পারলে তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় ‘কথা মেনে চলবে’—এ রকম মানুষকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পেতে চান যুগে যুগে, যাতে তাঁর হাত দিয়ে রাজনৈতিক তুষ্টিসাধক ঘাটতি বাজেট মেটানো, ইচ্ছেমতো বাজারবহির্ভূত সুদের হার বানানো কিংবা বিনিময়ের হার বা টাকার মান পেরেক মেরে বসিয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের চেয়ে চৌকস মডেল দিয়ে বাজারের কাছাকাছি থাকার সংখ্যা দিতে পারত। নিয়ন্ত্রণকারীরা গবেষক দেখলে এড়িয়ে চলে। ওদের কথা মেনে চললে আজ ধপাস করে পড়তে হতো না। আরও দশটা নিয়ন্ত্রণের সার্কুলার দিতে হতো না। বিলাসদ্রব্যের আমদানি বন্ধ করে শুল্ক হারাতে হতো না। দুর্বল রাজস্ব খাত আরও দুর্বল হলো। কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের বিদেশভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে হতো না। হঠাৎ আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাটা গায়ে আরেক দফা নুনের ছিটা দিতে হতো না।

এরই ফলে বছর দশেক ধরে চলছে সঞ্চয়পত্রের উন্মাতাল উচ্চহার এবং টাকার কৃত্রিম উচ্চদাম—দুটিই বাজারবহির্ভূত। দুটিই নীতি-গোঁয়ার্তুমি। দুটিই স্ববিরোধিতা, কারণ ১৯৯০ দশকের আর্থিক মুক্তায়ন (ফাইন্যান্সিয়াল ডিরেগুলেশন) ও ২০০০ দশকের বিনিময়ের হার ভাসায়ন (এক্সচেঞ্জ রেট ফ্লৌটিং)—এ দুটিরই শ্রাদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। দুটিরই উদ্দেশ্য স্বল্পকালীন রাজনৈতিক তুষ্টিসাধন। দুটির জন্যই জাতীয় অর্থনীতিকে শাস্তি পেতে হবে এবং এ শাস্তি ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির বেগবান হওয়ার ইতিহাস মানে বাজার অর্থনীতির ইতিহাস। কিন্তু নীতিমহলে আজকাল নিয়ন্ত্রণবাদের জয়ডঙ্কা বাজে। ডঙ্কা ফেটে যাবে। আজ টাকার আকস্মিক অধঃপতন সেই বাজারজ্ঞানহীন নিয়ন্ত্রণবাদের অনিবার্য পুরস্কার।

পত্রিকায় দেখলাম, অর্থ মন্ত্রণালয় ডলারের দাম বাড়বে না কমবে, তা নিয়ে বৈঠক ডেকেছে। ভাগ্যিস, এ খবর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তা জো বাইডেনের কানে আসেনি। এ সংবাদ এলে তিনি তো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যেতেন—তাঁর দেশের মুদ্রার মান কিনা ঠিক করে দেবে বাংলাদেশের সচিবালয়। প্রথমত, কাজটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত নয়। একটা দুর্বল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারণে আমরা ভুলেই গিয়েছি সুদের হার বা বিনিময়ের হার—এগুলোর নির্ধারণের কর্মটি কোনো দিনই কোনো মন্ত্রণালয়ের নয়।

এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। বঙ্গবন্ধুর হাতে করা ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ও ২০০৩ সালের সংশোধনী সেটাই বলে। পৃথিবীর সব দেশের নিয়মকানুনও তা-ই। ব্যতিক্রম শুধু আমরা। আজকের বিপর্যয় এহেন মাতব্বরির ফল। এ দেশের অর্থমন্ত্রীরা খেলাপি ঋণ, সুদহার, বিনিময়ের হার—এ-জাতীয় ব্যাংকিং বিষয় নিয়ে বেশি কথা বলেন। কম কথা বলেন নিজের অক্ষমতা নিয়ে। কর-জিডিপির হার মাত্র ৯ ভাগ, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিচু। রাজস্ব অক্ষমতা ঢাকার জন্যই সঞ্চয়পত্রের উচ্চহার। এরই পুরস্কার বিনিয়োগের হার ছাপিয়ে অলস সঞ্চয়ের দাপট। ২০২০ সালে সঞ্চয় ছিল জিডিপির ৩৬ ভাগ, বিনিয়োগ ৩০ ভাগ এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ মাত্র ২২ ভাগ।
দ্বিতীয়ত, কথাটা ভুল। ডলারের দাম কেউ কমায়-বাড়ায় না। ডলার সৌরজগতের সূর্যের মতো এক জায়গায় থাকে। অন্য গ্রহ-উপগ্রহ ওকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নেয়। টাকার দামও কেউ কমায় বা বাড়ায় না। ওটা আসলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময়ের মান সমন্বয়করণ। ওটা করতে গেলে দিন দিন ডলারের দাম বাড়তেই থাকবে। এতে লজ্জার কিছু নেই। তাহলে চীন আর লজ্জায় বাঁচত না; বরং যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে যে চীন নিজের মুদ্রামান ডলারের বিপরীতে বেশি নামিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যসুবিধা নিচ্ছে এবং আমেরিকার বাজার দখল করছে।

কেন ডলারের দাম দিন দিন বাড়বে? এর মূল কারণ দুই দেশের মূল্যস্ফীতির ফারাক। ডলার-টাকার যে বিনিময়ের হার আমরা প্রতিদিন দেখি, তার গভীরে থাকে ‘প্রকৃত বিনিময় হার’, যা একটা সূচক এবং যা মোটামুটি একটা সমতলে রাখার চেষ্টা করা হয়। সে জন্য মূল্যস্ফীতির ফারাক সমন্বয় করা আবশ্যক। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের মূল্যস্ফীতি গড়ে ৩ থেকে ৪ ভাগ বেশি থাকে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ভাগ ওপরেই থাকে। সেটার সমন্বয় সাধনে বাঙালির রাজত্বে ডলারের দাম দিন দিন বাড়া কিংবা টাকার আপেক্ষিক মান দিন দিন কমা এক অনিবার্যতা, এক স্বাভাবিকতা মাত্র। ধীরে ধীরে এ সমন্বয় করলে হঠাৎ করে বন্যায় বাঁধ ভাঙত না।

বাজার অর্থনীতির শুরু, অর্থাৎ ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডলারের দাম নিয়ে যদি একটা প্রবণতারেখা আঁকা যায় এবং সেই রেখার রিগ্রেশন সমীকরণ বের করা যায়, তাহলে ডলারের দাম বছরে ২ টাকা করে বাড়ার সংখ্যাটি বেরিয়ে আসে। তখন ৩২ টাকায় ডলার পাওয়া যেত। এ সমীকরণকে ব্যবহার করে ২০২২ সালের জন্য ডলারের দাম বেরিয়ে আসে ৯৫ দশমিক ৫৮ টাকা। এর আশপাশে থাকলে ক্ষতি কী ছিল? এটা তো বাজারের কাছাকাছিই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের চেয়ে চৌকস মডেল দিয়ে বাজারের কাছাকাছি থাকার সংখ্যা দিতে পারত। নিয়ন্ত্রণকারীরা গবেষক দেখলে এড়িয়ে চলে। ওদের কথা মেনে চললে আজ ধপাস করে পড়তে হতো না। আরও দশটা নিয়ন্ত্রণের সার্কুলার দিতে হতো না। বিলাসদ্রব্যের আমদানি বন্ধ করে শুল্ক হারাতে হতো না। দুর্বল রাজস্ব খাত আরও দুর্বল হলো। কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের বিদেশভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে হতো না। হঠাৎ আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাটা গায়ে আরেক দফা নুনের ছিটা দিতে হতো না। নীতির শুদ্ধতার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় শুধু আনুগত্যের সন্ধান করলে চলবে না; মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক নীতির বিকল্প নেই।

  • ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।