কলকাতার চিঠি

জয় নিয়ে শঙ্কায় মমতা!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মুখে যা-ই বলুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখনো ‘ভয়’ কাটেনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নির্বাচনী প্রচারে নেমে যেভাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানের জমি চষে বেড়িয়েছেন, তাতে সব সময়ই দেখা গেছে এক অজেয় শক্তির ধারক তিনি। পশ্চিমবঙ্গে তিনি উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। সুতরাং কে হারাবেন তাঁকে? তিনিই ফিরে আসছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসবেন। মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সুতরাং ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়ে তিনি মাঠে-ময়দানে তাঁর দলের জয়ের গানই গেয়ে গেছেন। বলেছেন, তিনিই উঠবেন বিজয়ের সিঁড়িতে। তুলে ধরবেন তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা। কিন্তু তিনি কি পাবেন সেই কাঙ্ক্ষিত জয়?
মমতার দলের মানুষেরা বলছেন, নিশ্চয়ই তিনি পারবেন বিজয় সিঁড়িতে উঠে তৃণমূলের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে। কিন্তু বিরোধীরা মমতার সেই কথায় সায় দিচ্ছে না। তাদের বক্তব্য, এবার অত সহজে জয় হবে না মমতার। বাম-কংগ্রেস বা বিজেপির নেতারা এখন রীতিমতো জোর গলায় বলছেন, নির্বাচন অবাধ হলে, ভোট ডাকাতি বন্ধ করা গেলে মমতার এবার মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে বসা কঠিনই হয়ে পড়বে। কারণ, এবার গোটা রাজ্যে মমতার ‘অপশাসন’-এর বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে বিরোধীরা। হয়তো মমতাও তিন পর্বের নির্বাচনের শেষে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছেন। তাঁর পায়ের তলার মাটি যে অল্প অল্প করে সরে যাচ্ছে, এবার হয়তো মমতা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন। তাই তিনি প্রথম পর্বের নির্বাচনের পর গলা নিচু করে মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। ভোটভিক্ষা করছেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার ২৯৪ আসনে নির্বাচন চলছে এখনো। ৪ এপ্রিল আরম্ভ হয়ে ১৭ এপ্রিল শেষ হয়েছে তৃতীয় দফার ভোট। এখন বাকি আরও চার দফার ভোট। ২১, ২৫, ৩০ এপ্রিল এবং ৫ মে এই ভোট নেওয়া হবে। তিন দফায় ১০৫টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখনো বাকি ১৮৯টি আসনের ভোট গ্রহণ। এই ১০৫টি আসনে কোন দল ভারী হয়েছে, তা এখনো বুঝে ওঠা যায়নি। কারণ, নির্বাচন চলাকালীন জনমত সমীক্ষা নিষিদ্ধ। তবু প্রথম দফার ভোটের পর বিরোধী বাম দলের নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, ‘আমরা ছক্কা মেরেছি। ওই ১৮টি আসনের মধ্যে আমরা কমপক্ষে ১২টি আসন পাচ্ছি।’ প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলও কম করে ১২টি আসনে জেতার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত বলেছে, ১৮টি আসনেই জিতবে তারা। দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণের পরও একই আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বাম-কংগ্রেস জোট। তবে তৃণমূল থেকে বলা হয়েছে, এই দুই পর্বে যে কটি আসনে নির্বাচন হয়েছে, সব কটিই পাচ্ছে তারা।
কিন্তু সত্যি কি তাই? রাজনৈতিক মহল কিন্তু সেভাবে বলছে না। তাদের হিসাব, মমতা যতটা আশা করছেন, ততটা আসন এবার পাচ্ছেন না। এখন মমতার নির্বাচনী প্রচার এবং হাবভাবে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে আগের আসনগুলো ধরে রাখতে পারছেন না তিনি। তবু নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিরোধী দলকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলে যাচ্ছেন, কয়দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে এই রাজ্যে? তারপর তো রাজ্যের হাতেই আইনশৃঙ্খলা। শুধু কি তাই, প্রতিটি জনসভায় তিনি একহাত নেন কংগ্রেস-বাম জোটকে। মমতার চোখে, কংগ্রেস বাম দলের সঙ্গে জোট করে যেন এক মহা অন্যায় করে ফেলেছে। বলছেন এটা এক অনৈতিক জোট। তবে এটা বলেন না, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কিন্তু এই কংগ্রেসের সঙ্গেই জোট করে তিনি নির্বাচনে লড়েছিলেন। জয়ী হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। শুধু কি তাই, তিনি ছিলেন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের মন্ত্রী। ছিলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের মন্ত্রীও।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও এখন মনে করছেন, মমতা হয়তো তিন দফা ভোটের পর এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এই বাম-কংগ্রেস জোটই এখন তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাম-কংগ্রেস জোট করায় বহু আসন এবার তাঁরা হারাবেন। তাই যে মমতা এত দিন তেমন একটা পাত্তা দেননি বিরোধী শিবিরকে, সেই মমতাই এখন তাঁর কণ্ঠস্বর নামিয়ে হাতজোড় করে ভোটারদের কাছে ভোটভিক্ষা করছেন। আশীর্বাদ চাইছেন।
এই তো সেদিন মমতা বর্ধমান জেলার আসানসোলের কুলটিতে নির্বাচনী জনসভায় এসে তাঁর চিরদিনের চড়া সুরের মাত্রাকে নামিয়ে হঠাৎ করে বলেন, ‘ক্ষমা করবেন। দোষত্রুটি সবই আমার। দোষত্রুটি যদি হয়, যদি কখনো ভুল বোঝেন, তাহলে আমার ওপর অভিমান করবেন, মান করবেন, কিন্তু দয়া করে আশীর্বাদ-শুভেচ্ছা-দোয়া তৃণমূলের মাথা থেকে সরিয়ে নেবেন না। তাহলে আমার পক্ষে পথচলা মুশকিল হয়ে যাবে।’ একইভাবে বিভিন্ন জনসভায় তিনি আরও বলেছেন, ‘ভুল করলে মানুষকে সংশোধন করার সুযোগ দিতে হয়। সব সময় আমি বলব না আমি সবজান্তা।’ এর আগে গত ২৮ মার্চ পুরুলিয়ার কাশীপুরে তিনি অবশ্য বলেছিলেন, ‘কেউ কোনো অন্যায়
করে থাকলে বলবেন। শাসন করে দেব। কিন্তু ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না।’ আবার এই মমতাই দোর্দণ্ড প্রতাপে ১৭ মার্চ আলিপুরদুয়ারের বীরপাড়ায় চড়া সুরে বলেছিলেন, ‘কে কোথায় প্রার্থী ভুলে যান। ২৯৪টি আসনের প্রার্থীই আমি।’ তখন পর্যন্ত মমতার এই ‘অহংকার’ ছিল তিনিই সর্বেসর্বা। তিনিই তৃণমূলের শেষ কথা।
কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোট এবং নির্বাচন কমিশনের অবাধ নির্বাচন করা নিয়ে তাদের ভূমিকা মমতার চিন্তাভাবনাকে ওলটপালট করে দেয়। মমতা অনুভব করতে থাকেন, তিনি হয়তো কিছু ভুল করেছেন, যা ভোটাররা এখনো মেনে নিতে পারেননি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসার পর তাঁর সরকার এবং দল জড়িয়ে পড়ে সারদা কেলেঙ্কারিতে। ব্যর্থ হন সিঙ্গুরবাসীর জমি ফিরিয়ে দিতে। অথচ এই সিঙ্গুর আন্দোলনকে হাতিয়ার করে তিনি ২০১১ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন। এরপর গত মাসে ফাঁস হয় নারদ কেলেঙ্কারির ভিডিও। তাতে দেখা যায়, তাঁর দলের ১১ নেতা ও মন্ত্রীর ঘুষ নেওয়ার দৃশ্য। এই ঘটনা সারদা কেলেঙ্কারির মতো অস্বস্তিতে ফেলে মমতাকে।
সর্বশেষ গত মাসে উড়ালসড়ক ভেঙে পড়ার ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৭ জন। এসব ঘটনার সমালোচনায় জেরবার হতে থাকেন মমতা। এরই মধ্যে ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, আসানসোলে এসে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে মমতার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেন। মোদি জানিয়ে দেন, মমতার মা-মাটি-মানুষের সরকার আজ দুর্নীতির সরকারে রূপ নিয়েছে। নারদ-কাণ্ডে মমতার নেতা-মন্ত্রীরা ক্যামেরার সামনে ঘুষ নিয়েছেন। তাই মমতার মা-মাটি-মানুষের সরকার আজ দুর্নীতির সরকার হয়ে গেছে। এই সরকারকে সরাতে হবে।
তাই মমতা এখন রয়েছেন প্রচণ্ড চাপের মুখে। তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন, ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। এসব ঘটনায় তাঁর নিজের এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তাই মমতা নতুনরূপে রাজনৈতিক ময়দানে উপস্থিত হয়ে মানুষের কাছে তাঁর এবং দলের ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে পরবর্তী নির্বাচনের তরি পার করাতে চাইছেন। কিন্তু এতে কত দূর তিনি সফলতা পাবেন, তা বোঝা যাবে আগামী ১৯ মে নির্বাচনের ফলাফল গণনার দিন।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।