জয়ের সমান এক পরাজয়

মহাভারতের ওই দৃশ্যটা মনে আছে? জয়ের কাছাকাছি কৌরবেরা। এমন সময় কৌরবকুলের সেনাপতি কর্ণের রথের চাকা কাদায় আটকে গেল। একমাত্র কর্ণই আরেক শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুনকে হারানোর যোগ্যতা রাখতেন। শিশুকালে মা তাঁকে পরিত্যাগ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ না হওয়ায় দ্রোণাচার্য তাঁকে ফিরিয়ে সব অস্ত্রবিদ্যা শেখান অহংকারী অর্জুনকে। কর্ণের সারাটা জীবন গেছে ভাগ্যের বিপক্ষে, দেবতার অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে। কিন্তু অন্তিমে আর পারলেন না। দেবতার ইশারায় কাদায় কর্ণের রথের চাকা আটকে গেছে। কর্ণ সেই চাকা ঠেলে ওঠাতে চেষ্টা করছেন। এ রকম বেকায়দা অবস্থাতেই অর্জুন তাঁকে তিরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। মহাভারতের কাহিনির অনেক ব্যাখ্যা হয়। কিন্তু সব বিচারেই কর্ণ ত্যাগ, সাহসিকতা, দানশীলতা, বীরত্ব ও নিঃস্বার্থপরতার জন্য আলাদা হয়ে আছেন।

বাংলাদেশের ভাগ্যটা যেন কর্ণের ভাগ্য। আমরা কাউকে ঠকাইনি, আমাদের যা অর্জন, তা সব সময় অস্বাভাবিক দামে আদায় করে নিতে হয়। খেলাই বলি আর জাতীয় জীবনে বলি, পরাশক্তির কুটিল খেলায় আমরা বাঁধা পড়ে যাই। আমাদের জয়রথের চাকা বারবার কাদায় পড়ে যায়। দলের সেরা দুই খেলোয়াড় সাকিব ও তামিম আহত। ভরসার মানুষ মাশরাফি আর তুখোড় মুশফিকও চোট ও ব্যথায় জর্জরিত অবস্থায় মাঠে নেমেছেন। এটা সেই খেলা যেখানে শরীর ও মনের সবটুকু শক্তি নিংড়ে এক করতে হয়, সেখানে আমরা নেমেছিলাম অর্ধেক শরীর নিয়ে।

বোলিং ভালো হলেও ব্যাটসম্যানরা নিজেদের যোগ্যতার সমান হতে পারলেন না। আবারও ফিরে এল ছয় বছর আগের মিরপুরের সেই মর্মান্তিক রাত। ২০১২ সালের এশিয়া কাপের সেই ফাইনালে আম্পায়ারদের দুটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দলের মনোবলে আঘাত হানল। ম্যাচজয়ের নায়ক মাহমুদউল্লাহকেও সন্দেহজনকভাবে সরিয়ে দেওয়া হলো। এবারেও লিটন দাসের প্রশ্নবিদ্ধ আউট হওয়া অসমাপ্ত গানের বেদনা হয়ে বাজল অনেকের মনে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে একচোখা পরিস্থিতি পার হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় ভারতের। সেবার ভারতের বিরুদ্ধে বোলিংয়ের প্রথম ৩০ ওভারে দারুণ করেছিল বাংলাদেশ। তার পরই এল রোহিত শর্মা ও রায়নাকে ধরাশায়ী করেও মাঠের বাইরে পাঠাতে না পারার হতাশা। আমাদের দুঃখটা বুঝেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা, ‘কাপ ছাড়া আর সবই জিতেছে বাংলাদেশ।’

এবারও যেন কেউ ছোঁ মেরে কেড়ে নিল সকালের সূর্যটা। মাশরাফিকে মনে হলো কর্ণের মতো। নইলে পুরো ম্যাচে দাপটের সঙ্গে খেলে শেষ মুহূর্তে জয়ের চাকা কঠিন মাটিতে আটকে যাবে কেন? নইলে পরাজয়ের পরেও কেন ক্রিকেট বিশ্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ দলের ভাবমূর্তি? কেন মাশরাফিকে ট্র্যাজিক বীরের মতো দেখাবে, কেন তাঁকে মনে হবে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণের মতো? কাদায় আটকে যাওয়া রথের চাকা সচল করতে যা যা করা সম্ভব, সবই করলেন। কিন্তু জয় আবারও হাতছাড়া হলো। নিয়তি তাঁকে বারবার নিষেধ করেছে। বলেছে, তোমার শরীরে অনেক ক্ষত, তুমি বাস্তবতার বিপক্ষে যুদ্ধে নেমো না। হায়রে বাস্তবতা! ছোট দেশের সমস্যাতাড়িত ক্রিকেট দলের সাধ হলো খেলার মধ্যে দিয়ে জাতীয় মর্যাদা অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। সেই যাত্রা কঠিন হলেও সম্ভবপর যে প্রতিটি প্রায়-বিজয়মুহূর্ত তা মনে করায়।

এবারের এশিয়া কাপে মাশরাফির অসাধারণ নেতৃত্বের কথা, মুশফিকের তুমুল ব্যাটিংয়ের কথা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু অন্তিম মুহূর্তে নিয়তি ছলনা করল। মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার পর বোলাররা যখন ভারতকে চেপে ধরে কখনো সমতা কখনো উচ্চতা প্রমাণ করছিল, তখন আশায় ঝলমল করে উঠেছিল শরতের রাতটা। তারপরও হলো না। অপরকে দুষে লাভ নেই, আমরা আমাদের আশার সমান হতে হতেও কেন হই না, তার সমাধান আমাদেরই হাতে আর তা আমাদেরই করে দেখাতে হবে। বারবার আমরা জয়ের দুয়ারে কড়া নেড়ে যাচ্ছি; এটাই–বা কম কী! এভাবেই একদিন জয়-পরাজয়ের মাঝখানের খাদটা আমরা ঠিক পেরিয়ে যাব।

তারপরও কথা থাকে। দক্ষ শিকারি যখন নিশানা করে, তখন সে আর কিছুই দেখে না, এমনকি পাখির পুরো দেহটাও নয়, কেবল মাথাটাতেই সব মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে তার। জাতীয় লক্ষ্যই বলি, রাজনৈতিক অভীষ্টই বলি, বলি শিরোপা অর্জনের নিশানার কথা, যা চাই তার জন্য সব প্রস্তুতি কি নিয়েছিলাম?

কর্ণই তো বলেছিলেন, ‘জয় নয়, অভীষ্ট চাহিয়াছি।’ বাংলাদেশ দলের জন্যও জয়ের থেকে যা বেশি, তা সেই অভীষ্ট: যার নাম সম্মান, যার নাম হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, যার নাম একেবারে তলা থেকে শীর্ষে উঠে আসার নাটকীয়তা। ক্রিকেট বিশ্বের নিম্নবর্গ হিসেবে, নিম্নবর্গীয় মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই উত্থান কলি উল্টানোর মতোই রোমাঞ্চকর। কিন্তু ইতিহাসের করুণ-কঠিন লীলা এই: নিম্নবর্গের উত্থান ট্র্যাজিকই হয়, ক্ষমতার অভিষেক হতে তার আরও বাকি।

মহাভারতের আখ্যানজুড়ে পরাজিত বীর কর্ণকেই বেশি উজ্জ্বল লাগে যেমন, তেমনি গতকালের পরাজয়ে ক্রিকেট বিশ্বে আরও উজ্জ্বলই হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরাজয় যেন জয়ের চেয়ে বেশি, আর ভারত যেভাবে জিতল, তা যেন পরাজয়েরই কাছাকাছি।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info