দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার কন্যা, কুমুদিনী ট্রাস্টের সাবেক পরিচালক, আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু জয়া পতি গত ৯ অক্টোবর (২০১৬) লন্ডনের এক হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে প্রয়াত হয়েছেন। সাক্ষাৎ-পরিচয়ের অনেক আগে, একাত্তরে তাঁর দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত, অন্য অনেকের মতো, আমারও জানা হয়ে গিয়েছিল এবং তখনই তিনি আমার শ্রদ্ধার আসনে পাকাপোক্ত ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।
তিনি তাঁর অসুস্থ বাবাকে দেখতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন এবং সেই অস্থির সময়ের বেড়াজালে জড়িয়ে দেশে থেকে যেতে বাধ্য হন। ৭ মে বাবা ও ভাই নিখোঁজ হলে ট্রাস্ট পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। তৎকালীন বাস্তবতায় কোনো নারী, বিশেষত হিন্দু নারীর জন্য কাজটা কত গুরুভার ও বিপৎসংকুল ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। শুরুতেই বিতণ্ডা বাধে সিঁথির সিঁদুর ও হাতের শাঁখা নিয়ে এক আর্মি অফিসারের সঙ্গে। শুনতে হয় নানা কুকথা। জয়া কড়া জবাব দেন। তারপর কত ঘটনা: ক্যান্টনমেন্টে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ, চলার পথে চেকপোস্টে বন্দুকের মুখে দাঁড়ানো এবং স্বগ্রাম মির্জাপুরে গণহত্যা। স্মর্তব্য, তখন ভারতেশ্বরী হোমসের হোস্টেলে কয়েক শ ছাত্রী, কুমুদিনী হাসপাতালে সহস্রাধিক রোগী, স্বজন ও কর্মী দলের সিংহভাগ ছিল যুবক-যুবতী। অধিকন্তু আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসা ও অন্যান্য সাহায্য জোগানো। বলা বাহুল্য, সবকিছুই চলেছে আর্মি ও গোয়েন্দা বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারি এড়িয়ে। জয়া পতির সৌভাগ্য, তিনি ছায়াসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন হোমসের অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দিকে। এমন দুর্বিপাক মোকাবিলায় যে নারী অটল থাকতে পারেন, তাঁকে অকুতোভয়, অনন্যা ছাড়া আর কী বলা যায়!
জয়া পতির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ সম্ভবত ১৯৯৪ সালের বসন্তে, বনানীর এক বন্ধুগৃহে। আমরা মস্কোর পাট উঠিয়ে সবে দেশে ফিরেছি। ইতিমধ্যে ডেইলি স্টার পত্রিকায় আমাদের ছবিসহ একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। সেটা দেখে জয়া আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ছেলে চন্দনের জন্য তাঁরা পাত্রী খুঁজছিলেন। দানবীরের পরিবারের এই প্রস্তাব এড়ানোর সুযোগ আমাদের ছিল না। তা ছাড়া জয়া পতি ও তাঁর স্বামী ডা. বিষ্ণুপদ পতির ব্যক্তিত্ব ও বিনয় আমাদের মুগ্ধ করেছিল। এভাবে আমাদের যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তা আর কোনো দিন এতটুকু ম্লান হয়নি। কন্যা সম্প্রদানের বছর খানেক পর জয়া ও বিষ্ণুপদ পতি এক চিঠিতে এমন অমূল্য পুত্রবধূ প্রাপ্তির জন্য আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা জানান। শাশুড়ি-পুত্রবধূ সম্পর্ক পৃথিবীর কোথাও সুমধুর নয়। অধিকন্তু আমাদের কন্যাটি আধা-রুশ। রাশিয়ায় বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে। দেখলাম, পরিবারবৃত্তেও জয়া অনন্যা।
স্বাধীনতার পর জয়া পতি ছাড়া ট্রাস্ট চালানোর মতো এই পরিবারে আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। জয়া পতি ট্রাস্টের হাল ধরলেন। বিষ্ণু পদ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের বাড়ি বিক্রি করে মির্জাপুর চলে এলেন এবং কুমুদিনী হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। যুদ্ধের নয় মাসের ধ্বংসযজ্ঞে সারা দেশের মতো কুমুদিনী ট্রাস্টের অবস্থাও তখন সঙিন। এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জে তাঁদের পাটের গুদামে ঘটল অগ্নিকাণ্ড, সম্ভবত অন্তর্ঘাত। একটি অত্যুৎসাহী মহল কুমুদিনী হাসপাতাল সরকারীকরণের জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল। জয়া পতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সবকিছু সামাল দিলেন। এ সময় তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকার দুস্থ মেয়েদের নিয়ে কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট গড়ে তোলেন, যা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে কুমুদিনী ট্রাস্টের একটি মহৎ উদ্যোগ। পরে প্রতিষ্ঠিত হলো পোশাকশিল্প ও ওষুধ প্রস্তুত কারখানা। এসব কর্ম সম্পাদনের জন্য কতটা শ্রম ও সময় প্রয়োজন, তা সহজবোধ্য। ট্রাস্টের জন্য জয়া পতি নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সুবাদে জয়া পতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ আমি পেয়েছি। লক্ষ করেছি, শিক্ষার প্রসার ও দরিদ্রের সেবার প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ আগ্রহ। এগুলো তিনি পেয়েছিলেন পৈতৃক ঐতিহ্যের সূত্রে। পিতা তাঁকে শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেননি, শরীরচর্চা এবং ঘোড়দৌড়ও শিখিয়েছিলেন। পরহিতব্রতে নিবেদিত এই প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন আদর্শ নেতৃত্ব। দুটি স্বপ্ন ছিল তাঁর—নার্সিং কলেজ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। শেষোক্ত উদ্যোগের একটি জরিপকর্মে আমিও কিছুদিন যুক্ত ছিলাম। জয়া পতির ভ্রাতুষ্পুত্র, ট্রাস্টের বর্তমান চেয়ারম্যান শ্রীমতি সাহা এবং এম ডি রাজীব প্রসাদ সাহা তাঁর প্রথম স্বপ্নটি পূরণ করেছেন। আশা করি, দ্বিতীয় স্বপ্নটিও অপূর্ণ থাকবে না।
আমি দীর্ঘদিন নটর ডেম কলেজে শিক্ষকতা করেছি। ওই কলেজের সঙ্গে কুমুদিনী ট্রাস্টেরও অনেক দিনের সম্পর্ক। আমাদের কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠানে কলেজের ফাদাররা এসেছিলেন। কিছুদিন পর কলেজে গেলে ফাদারদের সঙ্গে আড্ডা জমে। কথা প্রসঙ্গে তাঁদের একজন বলেন, ‘তোমার দেশে যে অল্পসংখ্যক নারী দেশ পরিচালনার যোগ্যতা রাখেন, তাঁদের মধ্যে জয়া পতিও আছেন।’
কথাটা নিয়ে অনেক দিন ভেবেছি এবং মনে হয়েছে ফাদার ভুল বলেননি।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।