নতুন সরকার—১১

জ্বালানি খাতে সরকারের চ্যালেঞ্জ

আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত দুই মেয়াদের সাফল্যের অন্যতম প্রধান খাত বিদ্যুৎ। ২০০৮-০৯ সালে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে লোডশেডিংয়ের দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাদের মনে আছে। কিন্তু তার পরের ১০ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ৫ হাজার মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। এটা একটা বড় দৃশ্যমান সাফল্য।

তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো গেলেও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহে সাফল্য অর্জন করা যায়নি। বরং অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। তার ফলে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। স্বল্প মূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতির চাকা স্বচ্ছন্দে চালু রাখতে পেরেছি। ২০১০ সাল নাগাদ গ্যাস–সংকট জ্বালানি খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। এখনো এ নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

২০১৫-১৬ সময়ে জ্বালানি সরবরাহের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়নকালে নির্ধারিত হয় যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখবে কয়লা, যার প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে। এটা উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বাড়ার একটি ধাপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাস–সংকট অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এলএনজি ব্যয়বহুল, এর ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

একটি হিসাব অনুযায়ী, যদি ব্যয়সাধ্য এলএনজি আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়, নির্মিতব্য বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি শুধু আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভরশীল হয়, যদি আমদানি করা তেলের ওপর বাড়তি নির্ভরশীলতা কমানো না যায় এবং যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ানো যায়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি হবে আমদানিনির্ভর। এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপর যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি সরবরাহ করা। এ জন্য জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভরতা থেকে সরে এসে দেশি জ্বালানি জোগানে আরও তৎপর হতে হবে।

বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা কখনো কখনো নীতিনির্ধারণী মহলকেও প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে—একটা সময়ে এ ধরনের প্রচারণা থেকে সরকারের উচ্চ মহল গ্যাস রপ্তানির পক্ষে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল। আর এখন বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে—এ রকম ধারণা অনেকের চিন্তা ও কর্মকে প্রভাবিত করেছে। অথচ দুটি ধারণাই ভুল। বাংলাদেশ গ্যাস অনুসন্ধানে এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। সুতরাং দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে—এই ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া ঠিক নয়। নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সার্ভিস কোম্পানির সাহায্যে একটি সাইসমিক জরিপ ও ডেটা প্যাকেজ তৈরি করা আবশ্যক, যেটি মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে নামে পরিচিত। পেট্রোবাংলা ২০১৪ সালে এটি করার উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে চার বছরেও তা সম্পাদন করা যায়নি। অথচ সাগরের গ্যাস দেশের জ্বালানি–সংকট লাঘবে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমার ও ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস সম্পদ আবিষ্কার ও আহরণ করে চলেছে। বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে না পারার অন্যতম কারণ মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভেনির্ভর ডেটা প্যাকেজের অভাব। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।

ভূখণ্ডে গ্যাস অনুসন্ধান কর্মপরিকল্পনা হতে হবে বাস্তবধর্মী। দেশি অনুসন্ধান সংস্থা বাপেক্স নিজস্ব উদ্যোগে বছরে তিন বা চারটি অনুসন্ধান কূপ খননে সক্ষম। এ সংস্থাকে দিয়ে প্রতিবছর ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করানোর পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। এর ফলে শুষ্ক ও ব্যর্থ কূপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। মন্ত্রণালয়ের অতি উত্সাহী একটি মহলের এই বাস্তবতাবর্জিত পরিকল্পনা আসলে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে, কারণ বছরে ১১টি নয়, মাত্র দুটি করে অনুসন্ধান কূপ খনন করা সম্ভব হয়েছে। ২০০৯ সালের পর সরকারি প্রশাসন বাপেক্সের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, এই সঙ্গে সংস্থাটির দক্ষ ও কারিগরি জনবল আরও বাড়ানো প্রয়োজন। আর বাপেক্সকে কূপ খননের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হওয়ার পর্যাপ্ত সুবিধাদি দিতে হবে, নইলে পাবনার মোবারকপুর কূপে গ্যাস পেয়েও না পাওয়ার ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি হবে।

বাপেক্স যে কূপটি ১০০ কোটি টাকায় খনন করতে সক্ষম, সেটি দ্বিগুণ বা তারও বেশি খরচে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে খনন করার যে ব্যবস্থাপনা কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যায়, তা অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে যেখানে কূপ খননে ঝুঁকি বেশি, যেমন ৫০০০ মিটারের বেশি গভীর বা পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিলতর ও বন্ধুরতর পাহাড়ি অঞ্চলে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বাপেক্স যোগ্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চারে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের নিজস্ব কয়লা সম্পদ মাটির নিচে রেখে আমদানিনির্ভর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিকল্পনার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। দেশে কয়লা খনন শিল্পের অধিকতর উন্নয়ন এখনই প্রয়োজন। দেশে নতুন কয়লাখনি নির্মাণ ও কয়লা উৎপাদনের শ্লথ ব্যবস্থাপনায় গতি আনা বর্তমান সরকারের জ্বালানি চ্যালেঞ্জের বড় উপাদান। দেশের একমাত্র কয়লাখনি বড়পুকুরিয়ায় কয়লা চুরি কেলেঙ্কারি খনি প্রশাসনে দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার স্বরূপ উন্মোচন করেছে। ২০০৫ সালে চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় বড়পুকুরিয়া খনি প্রতিষ্ঠার সময় আশা করা হয়েছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে খনির কারিগরিসহ সব ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ নিজের আয়ত্তে নেবে। কিন্তু ১৩ বছর পরেও খনিটি পরিচালনায় আমরা চীনা কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। এই দুর্বলতা অগ্রহণযোগ্য ও জাতীয়ভাবে লজ্জাজনক।

বর্তমানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা দেশের মোট উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৩০ শতাংশ। এ জন্য উচ্চ মূল্যের ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানির প্রয়োজন হয়। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ–সংকট মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়সাপেক্ষ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে ২০০৯ সালের পর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালুর মাধ্যমে। সে সময় এটা ছিল সাময়িক ব্যবস্থাপনার অংশ। ২০১৪ সালের মধ্যে সাশ্রয়ী জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে তেলনির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা করা হয়নি। বরং কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং আরও নতুন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।

জনস্বার্থে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ও সাশ্রয়ী জ্বালানি আবশ্যক। ২০১৯ সাল থেকে প্রতিদিন ১০০০ ইউনিট (মিলিয়ন ঘনফুট) এলএনজি গ্যাস আমদানি বাবদ ব্যয় হবে বছরে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সালে তা বেড়ে প্রতিদিন ২৫০০ ইউনিট হবে। এ বাবদে প্রতিবছর ৭০ হাজার কোটি টাকার এলএনজি গ্যাস আমদানি করতে হবে। বর্তমানে তেল আমদানিতে ব্যয় হয় বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সাল নাগাদ বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানি করতে হবে। জ্বালানির অন্যান্য খাতসহ সব মিলিয়ে প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। জাতীয় অর্থনীতির ওপর এই বিরাট আর্থিক চাপ আমরা কীভাবে সমন্বয় করব, তা ভেবে দেখার বিষয়।

বিদ্যুৎ সচ্ছল জনগোষ্ঠীর সীমানা ছাড়িয়ে প্রান্তিক জনগণের ব্যবহারযোগ্য করতে হলে, তা সাশ্রয়ী হতে হবে। এটা বর্তমান সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

ড. বদরূল ইমাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক