জ্বালানি–সংকট মেটানোর দিকনির্দেশনা নেই কেন

দেশ বিগত এক দশকে বিদ্যুৎ খাত যে সাফল্য অর্জন করেছে, জ্বালানি খাত তার ধারেকাছে নেই। অথচ জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে বড় অঙ্কের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। তদুপরি, উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ নির্ভর করে আমদানি করা জ্বালানির ওপর, যার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে কমে প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে গেছে। আর এর ফলে দেশীয় জ্বালানি তথা গ্যাসের পরিবর্তে ব্যবহার বাড়ছে আমদানি করা অতি উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার। প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের (এলএনজি) জন্য ব্যয় হয় ১২ ডলার (দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি) থেকে ৩৫ ডলার (স্পট মার্কেট) পর্যন্ত। এর ফলে সরকারের অর্থভান্ডারে যে টান পড়েছে, তা তৈরি করেছে এক নতুন সংকট।

এই সংকট সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে পেট্রোবাংলাকে, যা বড় আকারের আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত। অর্থের জোগান দিতে সরকারের সাবসিডি বা অনুদান, ব্যাংকের ঋণ বা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করার প্রস্তাব কোনোটাই জুতসই বলে প্রতীয়মান হয় না। এমনকি গ্যাস ডেভেলপমেন্টের ফান্ড (জিডিএফ) থেকে অর্থ নেওয়াকে অনেকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন। কারণ, এই তহবিলটি তৈরি করা হয়েছিল কেবল দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নের স্বার্থে। এটি এলএনজি কেনায় খরচ করার জন্য নয়। আবার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে এর সমাধান করার চলমান প্রক্রিয়াটি কেবল এ সমস্যাকে প্রাতিষ্ঠানিক দায় থেকে নামিয়ে জনগণের ঘাড়ে এনে ফেলার শামিল। এতে সমাধান নয় বরং সংকটের ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে মাত্র। কারণ, মহামারির কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠী যে আর্থিক সংকটে পড়েছে, তা কেবল বৃদ্ধি পাবে। আর নির্বাচনের ঠিক আগের বছর গণ–অসন্তোষ সরকারি দলের জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনবে না।

এই সংকট সমাধানের উপায় কী? কোথায় তার দিকনির্দেশনা? গত মাসে ঘোষিত জাতীয় বাজেটে দেশে জ্বালানি–সংকট মেটানোর কোনো দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা নেই। কী রকম হবে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নের পথরেখা বা রোডম্যাপ? একটি জাতীয় বাজেট কেবল বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দের নথি নয় বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের রূপরেখা, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দর্শন বটে। দেশ তার জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এই মুহূর্তে কোন পথে যাবে? দেশীয় জ্বালানি জোগান ব্যবস্থাপনার ধারা এক রকম এবং তা স্বনির্ভর ও সাশ্রয়ী। আর আমদানি করা জ্বালানি জোগান ব্যবস্থাপনার পথ ভিন্নতর এবং তা পরনির্ভরশীল ও ব্যয়বহুল। প্রথমটি ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর দ্বিতীয়টি হলো বর্তমান ধারা, যা চলমান। বিগত ২০ বছরে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বা দেশীয় কয়লা উন্নয়নে যে ন্যূনতম কর্মধারা চলে, তাতে আর যা–ই হোক নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো অসম্ভব। প্রতিবছরের বাজেট ঘোষণায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার একটি অল্প অংশ বরাদ্দ হয় জ্বালানি খাতে। আর এ বছরের বাজেটেও তার ব্যতিক্রম নেই।

বাংলাদেশ তার উন্নয়নের ধারাকে চলমান রাখতে গ্যাস ও কয়লার ব্যাপক ব্যবহার করছে এবং নিকট ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাসসম্পদ ও কয়লাসম্পদ মাটির নিচে সঞ্চিত রয়েছে। এসমূহকে উত্তোলন করে নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে জ্বালানি আমদানিনির্ভরশীলতা কমানোর নীতি অবলম্বন করা আবশ্যক।

প্রশ্ন হলো আমরা আমাদের কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি কেন? ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেল অয়েলের কাছ থেকে তাদের আবিষ্কৃত ও পরিচালিত পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ কিনে নেয় এবং আমরা আজ অবধি এসমূহ বাংলাদেশের জাতীয় তথা নিজস্ব গ্যাস মজুতের অংশ হিসেবে অতি অল্প মূল্যে তা ব্যবহার করি। কিন্তু এখন সময় ভিন্নতর। গ্যাস সরবরাহে একচেটিয়া আধিপত্য মার্কিন শেভরন তেল কোম্পানির। দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন করে শেভরন। বিদেশি তেল কোম্পানি দেশে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহকাজে বড় ভূমিকা রাখলে ক্ষতির কিছু নেই, কিন্তু তা যখন পুরোপুরি এককেন্দ্রিক বা একপেশে হয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় থাকে।

গত রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের দিন শেভরন তার বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে কারিগরি জটিলতার কারণে কেবল পাঁচটি কূপ সাময়িকভাবে বন্ধ করেছিল। তার প্রভাবে শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেকেই আশঙ্কা করেন, শেভরনের গ্যাসক্ষেত্রগুলো নিকট ভবিষ্যতে বড় আকারের উৎপাদন হ্রাসের প্রভাবে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে বিরাট গ্যাস–সংকট দেখা দেবে, তা মোকাবিলার জন্য আমাদের বিকল্প প্রস্তুতি আছে কি? বর্তমানে দেশে মোট গ্যাস সরবরাহের কেবল ২৫ শতাংশ আমদানি করা এলএনজি দ্বারা মেটানো হয়। এর অতিরিক্ত এলএনজি আমদানি করার জন্য দেশে না আছে অবকাঠামো, না আছে আর্থিক সচ্ছলতা। অদূর ভবিষ্যতের এ রকম সংকটময় পরিস্থিতির আশঙ্কা নিয়ে মাথা না ঘামানোর মানে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানো।

কিন্তু এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়লাম কেন। বাংলাদেশের মতো এ রকম ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক গঠনে গড়ে ওঠা বদ্বীপ অঞ্চল তো গ্যাসসম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা, অন্তত বিশ্বের অন্যান্য বদ্বীপ অঞ্চলকে বিবেচনায় নিলে। তদুপরি, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নেও একই মত প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস পেট্রোবাংলার সঙ্গে যৌথ জরিপে দেখায় যে বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৩২ টিসিএফ। একই সময় নরওয়ের জাতীয় তেল–গ্যাস কোম্পানি এনডিপি বাংলাদেশ সরকারি এজেন্সির সঙ্গে সম্পাদিত জরিপে দেখায় যে দেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। ২০১৮ সালে ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শক র‍্যামবোল তাদের জরিপে দেখায় যে এর পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। এরা সবাই যে বিষয়ে একমত তা হলো, বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে গ্যাস–সংকট তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাসসম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুক্কায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে এই দেশে গ্যাস–সংকট থাকবে না।

বাংলাদেশের দিনাজপুর–রংপুর অঞ্চলে বড় আকারের কয়লা মজুত রয়েছে। এর একটি বড়পুকুরিয়ায় ২০০৫ সাল থেকে অল্প আকারে ভূগর্ভস্থ খননপদ্ধতির মাধ্যমে কয়লা উঠিয়ে একটি কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র চালু রয়েছে। বর্তমানে উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদার তুলনায় কম বলে সক্ষমতার তুলনায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। সর্বোপরি এটি গণ্য করা হয় যে আগামী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০২৭ সালে বর্তমান খনি থেকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর কী হবে? বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার জোগান দেবে কে? বড়পুকুরিয়ায় কি অধিগ্রহণকৃত জমিতে উন্মুক্ত খনন করে বাড়তি কয়লা তোলা হতে পারে, নাকি অন্য কোনো কয়লা মজুতে (যেমন দীঘিপাড়া) ভূগর্ভস্থ খনি স্থাপন কবে কয়লা জোগান দেবে। বাংলাদেশের কয়লা উন্নয়নে সরকারের নীতিমালা সুস্পষ্ট ধারণা কারও আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশ কয়লাভিত্তিক বড় আকারের বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। এসব চলবে সম্পূর্ণরূপে আমদানি করা কয়লার ওপর ভিত্তি করে। দেশের কয়লা মাটির নিচে রেখে বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার নীতি চললে প্রশ্ন ওঠে এ নীতির যৌক্তিকতা কোথায়? ঘোষিত বাজেটে এর কোনো উল্লেখ নেই। নেই কোনো কয়লা সম্পদ উন্নয়নের দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশ তার উন্নয়নের ধারাকে চলমান রাখতে গ্যাস ও কয়লার ব্যাপক ব্যবহার করছে এবং নিকট ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাসসম্পদ ও কয়লাসম্পদ মাটির নিচে সঞ্চিত রয়েছে। এসমূহকে উত্তোলন করে নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে জ্বালানি আমদানিনির্ভরশীলতা কমানোর নীতি অবলম্বন করা আবশ্যক। দেশের গ্যাসসম্পদ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে, এ ধারণা অবৈজ্ঞানিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মুহূর্তে নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভবিষ্যতের পথে ক্রমাগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন করার নীতি গ্রহণ করাই হবে সঠিক দিকনির্দেশনা।

ড. বদরূল ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক