যুক্তরাজ্য

জেরেমি করবিন: আদর্শের ফেরিওয়ালা

জেরেমি করবিন
জেরেমি করবিন

লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়ে ব্রিটেনের রাজনীতিতে বড় একটা দোল দিয়ে দিলেন জেরেমি করবিন। করবিনপন্থীদের আশার বেলুন এক্ষণে আকাশ ছুঁতে চাইছে। অন্যদিকে, দলের ভেতরের ও বাইরের করবিনবিরোধীরা ভূতের পর ভূত দেখতে শুরু করেছেন। কী আছে করবিনে যে এক পক্ষের আশা তুঙ্গস্পর্শী এবং অপর পক্ষে ক্রোধ-আশঙ্কা বিস্তর? করবিন ‘নিউ লেবার’ নীতির নামে রাজনীতিতে লেবার পার্টির সুবিধাবাদিতা চর্চার বিরোধী। করবিন লেবার পার্টিকে আবারও লেবার পার্টির নিজস্ব আদর্শের কাছে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে নির্বাচনী সাফল্যের ধুয়া তুলে শ্রমজীবী ও নিম্ন মধ্যবিত্তের কাছ থেকে দলকে দূরে সরিয়ে দেওয়া নিউ লেবার নীতিমালার আছর থেকে দলকে বাঁচাতে চান করবিন। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও নিউ লেবার অবস্থানের তীব্র বিরোধী করবিন। করবিন এমন কতগুলো অবস্থান নেওয়ার কথা বলছেন, যেগুলোর কথা ব্লেয়ার আমল থেকে লেবার পার্টি তেমন একটা বলে না; কখনো কখনো শরমায়, এমনকি বিরোধিতা করে।
করবিন মনে করেন, কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার জেরে নিম্ন আয়ের মানুষজনের জান খারাপ হয়ে যাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের দায় আছে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের আসল অনুরাগ বড়লোক, বড় ব্যবসা ও বড় মুনাফাখোরদের জন্য। নিজের দলকে একই রাস্তায় হাঁটা থেকে বিরত রাখতে অনেক দিনের চেষ্টায় আছেন করবিন ও তাঁর সাথিরা। সত্যিকারের গণতন্ত্রকে কেন্দ্রে রাখা, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা, শান্তি ও সমতা বিধান হচ্ছে করবিনের আদর্শ। গণতন্ত্র কেবল বাইরে বাইরে নয়; দলের মধ্যেও। এ কারণে করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টিতে কমে যাবে কেবলই এমপিদের মাতবরির সংস্কৃতি। এখন থেকে দলে গুরুত্ব পাবেন তৃণমূল, ইউনিয়ন ও সাধারণ সদস্যরা। সুখবর আছে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকা বৈধ-অবৈধ অভিবাসী, নানা দেশে প্রাণ হাতে নিয়ে থাকা শরণার্থীদের জন্য। ২০০৮ সালের দিকে মন্দার শুরু থেকেই যাবতীয় সমস্যার জন্য বৈধ-অবৈধ অভিবাসীদের দায়ী করার প্রবণতা চলছে ইউরোপজুড়ে; ব্রিটেনে বেশ জোরেশোরে। ভোটের জন্য এ অবস্থান বেশ লাভজনক লেবারদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমানে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির জন্য। দেখে দেখে আদর্শিক দিক থেকে সংখ্যালঘু ও অভিবাসীবান্ধব লেবার পার্টিও মাঝেমধ্যে দোনোমনা হয়। করবিনের কোনো দোনোমনা নেই। তিনি মনে করেন, অভিবাসন নানা দিক থেকে ব্রিটেনকে সমৃদ্ধ করে। জীবন বাঁচাতে ইউরোপের প্রবেশদ্বারে পড়ে থাকা শরণার্থীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পাশ কাটানো অবস্থানের কড়া বিরোধী করবিন। ন্যাটোর জন্য বাড়তি খরচায় আপত্তি আছে তাঁর। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার স্বৈরাচার, আইএসের সমালোচনা ঠিক আছে, কিন্তু বাহরাইনি একনায়ক কিংবা ইয়েমেনে সৌদি বোমা হামলার সমালোচনা কেন নয়? স্পষ্ট যে এসব অবস্থান ব্রিটিশ এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে যাচ্ছে না, এমনকি নিউ লেবারের সঙ্গেও নয়। এরা করবিনকে ছেড়ে কথা বলেনি, তবু রুখতে পারেনি। জাদুটা কোথায়?

করবিন সাধারণের ছায়াপথ হয়ে থাকতে পারবেন, নাকি ধূমকেতু চরিত্রে সমাপ্ত হবেন? দলের ভেতরের নিউ লেবাররা, প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টি আর ব্রিটেনের প্রথাগত স্বার্থবাদীরা করবিনকে শান্তি দেবে না, এটা নিশ্চিত

মে মাসের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির কাছে হেরে ভূত হয়ে রীতিমাফিক লেবার পার্টির নেতৃত্ব ছেড়ে দেন এড মিলিব্যান্ড। দলের জন্য নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যে চারজন প্রার্থী আবির্ভূত হন, তাঁদের মধ্যে জেরেমি করবিন ছিলেন বলতে গেলে একজন নিতান্ত ‘বেচারা’ অথবা একজন ‘পুরানা পাপী’, যিনি কিনা নিউ লেবার রাজনীতির চোখা চোখা সমালোচনা করে দলকে বিব্রত করেন। দলের ২৩০ জনের মধ্যে মাত্র ২০ জন এমপি নেতা নির্বাচনে আলাপ-আলোচনার পরিধি বাড়ানোর যুক্তিতে করবিনকে সমর্থন দেন। ধারণা করা হয়েছিল, ‘ব্যাকবেঞ্চার’ এই এমপি কিছু নীতিকথা বলবেন, দলের অধঃপতন নিয়ে কিছু কড়া কথা শোনাবেন এবং কয়েক দিন পরে চুপসে যাবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটে পুরো উল্টো। নিউ লেবারদের চোখ উল্টে দিয়ে বিপুলসংখ্যক লোক করবিনের দিকে ছুটতে শুরু করেন। লেবার পার্টিকে লেবার পার্টি হিসেবে দেখতে চাওয়া লেবার পার্টির সাধারণ সদস্যরা অনেক দিন বাদে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। রাজনীতি নিয়ে নিতান্ত উদাসীন তরুণদের মধ্যেও সাড়া পড়ে যায় করবিনকে নিয়ে। লেবার রাজনীতিতে অনেক দিন হয় তথাকথিত চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে ওঠাটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। দলের নিয়ন্ত্রকদের কাছে দলের আদর্শ অনেক দিন থেকেই গৌণ। দলের সমর্থকদের প্রধান অংশ তথা নিম্ন আয়ের মানুষজনের স্বার্থের ব্যাপারে জোর লড়াইয়ে অনীহা; শরমিন্দা ভাব।
নেতা হওয়ার লড়াইয়ে এসে করবিন করলেন কী, তিনি খারাপ অনুশীলনটাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন এবং এই চ্যালেঞ্জের ব্যাপারটা সারা দেশের অনেক লোকের ভালো লেগে গেল। লেবার পার্টির ভেতরে একটা গণজাগরণ হয়ে গেল। সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি লেবার সদস্য নেতা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন। এঁদের মধ্যে সাড়ে চার লাখ লোক ভোট দিয়েছেন, তার মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ ভোট পেয়েছেন করবিন; বাকি তিন প্রার্থীর কেউ ২০ ভাগ ভোটও পাননি। এই যে এতগুলো ভোট পেলেন, লক্ষণীয় ব্যাপার, করবিনকে মিডিয়াকে তেল মারতে হয়নি; গুডি গুডি ভাব করতে হয়নি। বড় বড় মিডিয়া শুরু থেকেই তাঁর পেছনে লেগে ছিল; শেষের দিকে ব্যাপারটা যাচ্ছেতাই হয়ে দাঁড়ায়। লেবার পার্টির বাইরের লোকজন, দলের ভেতর-বাইরের বিরোধীরা করবিনকে দস্তুরমতো জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেন। অবশ্য তাঁদের বোধ হয় গত্যন্তর ছিল না। ভুয়া দলিল অবলম্বন করে ইরাক আগ্রাসনে অংশ নেওয়ার জন্য ব্রিটেনের দুঃখ প্রকাশের পক্ষে করবিন। করবিন পরমাণু অস্ত্রেরও বিপক্ষে। তিনি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইসরায়েলের জায়নবাদী নীতির তীব্র বিরোধী—এ জন্য তাঁকে হামাস-হিজবুল্লাহপন্থী হওয়ার অভিযোগ শুনতে হয়। মোট কথা, করবিনের সামগ্রিক অবস্থান দলের ভেতর-বাইরের বৃহৎ স্বার্থবাদীদের ভালো লাগার কথা নয়। দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, করবিনের নেতৃত্বে তাঁদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। ফল প্রকাশের পরপরই তাঁরা সরতেও শুরু করেছেন। দলের ভেতরে ব্লেয়ার আমল থেকে দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া নিউ লেবাররা দলে গৃহযুদ্ধের প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়ে ফেলেন। দল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে এঁরা এতটাই উতলা হয়ে পড়েন যে নিউ লেবার ধারণার প্রবক্তা টনি ব্লেয়ার স্বয়ং কলম ধরেন জেরেমি করবিনের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, করবিনের রাজনীতি ‘এলিস ইন ওয়াল্যান্ডের’ ‘ফ্যান্টাসি’ ছাড়া আর কিছু নয়। করবিনের নেতা হওয়া মানে, ব্লেয়ারের মতে, লেবারের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাওয়া। এমনকি করবিনের আদর্শের রাজনীতি লেবারকে ব্রিটিশ রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় করে ফেলতে পারে বলেও সতর্ক করে দেন ব্লেয়ার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসব কথায় এতটুকু হয়নি। বরং জেরেমি করবিন নামের পঁয়ষট্টি পেরোনো লোকটি লেবার পার্টির দেড় শ বছরের ইতিহাসে বিপুল এক বিস্ময় হিসেবে দেখা দিয়ে জনমনে রাজনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে দারুণ আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হলেন বহুদিন বাদে। তা-ও আবার কোন সময়ে? যখন কিনা ব্রিটেনের মতো দেশে লোকে রাজনীতির নামে বিরক্ত, তরুণেরা রাজনীতি নিয়ে দৃশ্যত অনাগ্রহী, নব্য উদারনীতিওয়ালাদের পীড়নে উদারনীতিবাদের রাজনীতি প্রায় গায়েব।
করবিন শেষ পর্যন্ত লেবার পার্টিকে কোথায় নিয়ে যাবেন, তা বলা যাচ্ছে না। করবিন সাধারণের ছায়াপথ হয়ে থাকতে পারবেন, নাকি ধূমকেতু চরিত্রে সমাপ্ত হবেন? দলের ভেতরের নিউ লেবাররা, প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টি আর ব্রিটেনের প্রথাগত স্বার্থবাদীরা করবিনকে শান্তি দেবে না, এটা নিশ্চিত। দলের সাধারণদের ওপর আস্থা রেখে দলের নেতা হওয়ার পরের ধাপ তথা সর্বসাধারণের আস্থা জয় করে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি করবিন? পরবর্তী নির্বাচনের অনেক দেরি। তত দিনে টেমস নদীতে অনেক জল গড়াবে। করবিন যদি কোনো দিন প্রধানমন্ত্রী না-ও হতে পারেন, তবু কেবল এই পাঠ তৈরি করার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন যে রাজনীতিতে আদর্শের আবেদন এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।