বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার যে দীর্ঘসূত্রতা তাতে এক বছরের চার মাসের মাথায় কোনো মামলার রায় হওয়া ব্যতিক্রমী ঘটনাই বলতে হবে। গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের তিনটি বাস রেষারেষি করতে গিয়ে একটি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ওপর উঠে পড়ে। এতে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬) নিহত হয়।
গত রোববার আদালত দুই বাসের দুই চালক ও এক সহকারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই ঘটনায় বাসমালিক ও এক সহকারী খালাস পেয়েছেন। দিয়ার মা রোকসানা বেগম রায় শোনার পর মেয়ের ছবি নিয়ে কাঁদছিলেন। প্রথম আলোর সংবাদ থেকে তাঁর মনের কথা জানা গেল। তিনি বলেন, ‘রায়ে আমি সন্তুষ্ট। মেয়েকে তো আমি ফিরে পাব না। ও আইনজীবী হতে চেয়েছিল, স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল।’ রাজীবের মা মাহিমা বেগমের অনুভূতিও ভিন্ন কিছু ছিল না। বলেন, ‘মা হয়ে ছেলে হারানোর কষ্ট কীভাবে ভুলব? আদালতের কোনো রায় বা শাস্তি স্বজন হারানো মানুষের বেদনা ঘোচাতে পারবে না। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।’
তারপরও প্রতিটি ঘটনার বিচার হওয়া জরুরি। আইন ভঙ্গের দায়ে কারও শাস্তি হলে অন্যরা সতর্ক থাকবেন। আইন ভাঙতে দ্বিধা করবে। আর শাস্তি না হলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এটি শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু নয়, সব অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিচারক তাঁর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, পরিবহন খাতে বেশি উপার্জনের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং চালক-সহকারীদের খামখেয়ালিতে সড়কে দুর্ঘটনার নামে হত্যার ঘটনা ঘটছে। এটি বন্ধ করতে হবে। তিনি দুর্ঘটনা এড়াতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি পথচারীদেরও সতর্ক হতে বলেছেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, আমরা চাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সড়কের নিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এবং জনবিরোধী, স্বার্থান্বেষী ও অগণতান্ত্রিক আসুরিক শক্তির কাছে নতি স্বীকার করবে না। একই কথা বলেছেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।
বাসচাপায় দিয়া-রাজীবের মৃত্যুর মামলার রায়ে অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই একে দেখেছেন ন্যায়বিচারের অংশ হিসেবে। কিন্তু সেই সঙ্গে এ–ও স্বীকার করতে হবে যে ওই দুর্ঘটনার পর দেশব্যাপী তোলপাড় না হলে এত দ্রুত বিচার হতো কি না, সন্দেহ। আমরা লক্ষ করছি, যেসব ঘটনায় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়, প্রতিবাদ করে, সেসব ঘটনার বিচার দ্রুত হয়। ফেনীর নুসরাত জাহান হত্যার ঘটনায়ও এমনটি ঘটেছে।
দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ২২১ জন। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। চলতি বছরে দুর্ঘটনা ও মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে মানুষ আন্দোলন করলে কিংবা সরকার আইন কার্যকর করতে গেলেই পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা হইচই করে ওঠেন। কিন্তু ভেবে দেখেন না যে দুর্ঘটনায় শুধু বাসের যাত্রী মারা যায় না। পরিবহনশ্রমিকও মারা যান। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের উদ্দেশ্য পরিবহনশ্রমিকদের শাস্তি দেওয়া নয়। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর সড়ক যান চলাচল নিরাপদ হলে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরাই বেশি লাভবান হবেন। সম্প্রতি ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হলো তাতে অন্যদের সঙ্গে মাইক্রোবাসের চালকও মারা গেছেন। এই মৃত্যুর জবাব কী। পরিবহন মালিক বা শ্রমিক সংগঠন কি তাঁর পরিবারের দায়িত্ব নেবে? সড়ক, নৌ, কিংবা রেল—সব পথেই যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আমাদের চারপাশে এত বেশি দুর্ঘটনা ও অঘটন যে নিজের গায়ে না পড়লে আমরা বিচলিত হই না। তারপরও কোনো কোনো ঘটনা জনমনে ভীষণ নাড়া দেয়। যেমন নাড়া দিয়েছিল দিয়া ও রাজীবের মৃত্যুর ঘটনা। যেমন নাড়া দিয়েছিল নুসরাত হত্যার ঘটনা। কিন্তু রাষ্ট্রকে তো প্রতিটি অঘটন ও অপরাধের বিচার করতে হবে। রাষ্ট্র সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই ২০১৮ সালের আগস্টে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছিল। তারা শুধু নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনই করেনি, কীভাবে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হয়, সেই পথও দেখিয়েছিল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কিন্তু আইন নিজের হাতে নেয়নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল পরীক্ষা করেছে, যেসব যানবাহনের চালক গাড়ির ফিটনেস সনদ, হালনাগাদ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেননি, সেসব যানবাহন পুলিশের জিম্মায় দিয়েছে। পুলিশকে মামলা করতে বলেছে।
এই কিশোর-তরুণেরা আমাদেরই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হয়। পূর্বসূরিরা অন্ধ হলে উত্তরসূরিরাই পথ দেখায়। রাস্তায় যে কাজটি ট্রাফিক পুলিশের করার কথা, বিআরটিএর করার কথা, সেই কাজটি করল কিশোর-তরুণেরা। প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য এই আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন ‘কিশোর বিদ্রোহ’। সেই কিশোর বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটেই সরকার দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনটি সংসদে পাস করে।
দুর্ভাগ্য, সরকারের ভেতরেরই কেউ কেউ আইনটি কার্যকর হতে দেয়নি। দুই মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এর বিরোধিতা করে। তারা ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে। শাজাহান খান তখন নৌপরিবহনমন্ত্রী আর মসিউর রহমান স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিমন্ত্রী। একই সঙ্গে শাজাহান খান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও মসিউর রহমান পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। তাঁরা সংসদে ও মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে আইনকে অনুমোদন দিয়েছেন, সেই আইনের বিরুদ্ধে দুই মাস পর ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করেছেন। বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধর্মঘট ডাকার সাহস না পেলেও এই দুই সাবেক মন্ত্রী পেয়েছিলেন। এখন তাঁরা মন্ত্রী নেই। তাই সরকার গত নভেম্বরে পরিবহন আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নিলে ফের তাঁরা মাঠে নামেন। আইনের বিভিন্ন অসংগতির কথা বলে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।
নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ যাত্রীদের সচেতন হওয়ার উপদেশ দেন। যাত্রীদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। নিরাপদ সড়কের জন্য মালিক-চালক, যাত্রী-পথচারী সবাইকে সজাগ হতে হবে। কিন্তু মানুষ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকলেও যদি বাস এসে কৃষ্ণা রায়ের মতো কাউকে চাপা দিয়ে যায়, তখন যাত্রী বা পথচারীরা কী করবে?
যাঁরা পরিবহন আইনের বিরোধিতা করছেন, তাঁরাও ভালো করে জানেন, বেপরোয়া যানবাহন চালানোর কারণেই সড়কে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এটি থামানো প্রয়োজন। কিন্তু একশ্রেণির পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নিরাপদ সড়ক চান না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় বের করে মানুষ মারার ছাড়পত্র চান।
যাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন, তাঁদের জাগানো সম্ভব। কিন্তু যাঁরা জেগে ঘুমান, তাঁদের ঘুম ভাঙাবে কে?
সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com