অস্ট্রেলিয়ান সম্পাদক এবং প্রকাশক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে আটক করার এবং তাঁর সম্ভাব্য প্রত্যর্পণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির নজির নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ মামলা হয়েছে এবং যে প্রক্রিয়ায় তাঁর বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এসব প্রশ্ন আমাদের এড়িয়ে গেলে চলবে না। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিয়ে যেভাবে বিচার করা হচ্ছে এবং তাঁকে যেভাবে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে তা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক আইনের আদর্শ মানদণ্ডের প্রতি সুস্পষ্ট আঘাত।
উইকিলিকস যেসব প্রচণ্ড প্রতাপশালী দেশের মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়কদের গোপন নথি ফাঁস করে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল, সেসব রাষ্ট্রের সরকারগুলো একজোট হয়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে সুকৌশলে অপপ্রচার করেছে। তারা অ্যাসাঞ্জকে এক ভীতিকর দানব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে এটিই প্রমাণিত হয়েছে, জনগণের ভোটে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছেন, তাঁরা তাঁদের নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থানে রাখতে এবং নিজেদের অবস্থানকে জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।
মালয়েশিয়া এই দেশগুলোর মধ্যে একটি এবং আমরা যদি সত্যিকার অর্থে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সংস্কার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। যে সাংবাদিকেরা গোপন নথি ফাঁস করেছেন এবং সেই কাজটিকে জনস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে দাবি করেছেন, তাঁদের যদি হরেদরে খলনায়ক বানানো না হতো, তাঁদের যদি জেলে পুরে দেওয়া না হতো এবং তাঁদের জীবন-জীবিকা যদি ছিনিয়ে নেওয়া না হতো, তাহলে আজ আমরা যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে পড়েছি, তা হয়তো এড়ানো সম্ভব হতো।
এই ভুয়া খবর ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের যুগে যাঁরা বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে অনেক গোপন নথি প্রকাশ করে প্রকারান্তরে সত্য প্রকাশে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা দেখানো উচিত বলে মনে করি। এ মুহূর্তে জবাবদিহির শূন্যতায় উইকিলিকস যে পথ দেখিয়েছে, তাকে আরও এগিয়ে নিতে আমাদের আরও অনেক সাহসী ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিক দরকার।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকতার সঙ্গে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের বৈরী সম্পর্ক চিরকালই ছিল। এখনো আছে। কিন্তু এই দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য থাকাটা জরুরি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বিশ্বজুড়েই এই দুই পক্ষের রেষারেষিকে একটি ভারসাম্যমূলক জায়গায় রাখার প্রয়োজনীয়তা বহুকাল ধরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকতার সঙ্গে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের বৈরী সম্পর্ক চিরকালই ছিল। এখনো আছে। কিন্তু এই দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য থাকাটা জরুরি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বিশ্বজুড়েই এই দুই পক্ষের রেষারেষিকে একটি ভারসাম্যমূলক জায়গায় রাখার প্রয়োজনীয়তা বহুকাল ধরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের আন্তর্জাতিক বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় একটি দেশ পরিচালনার জন্য গোপনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। যদি সংবাদমাধ্যম ও সরকারগুলোর মধ্যে আরও সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, তাহলে ভারসাম্য ব্যবস্থার ওপর নজরদারি সহজ হবে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যেভাবে হয়রানি করা করা হচ্ছে এবং বিচারের নামে যা চলছে, আমি তার নিন্দা জানাই এবং তাঁকে এখনই এসব হেনস্তা ও নির্যাতন থেকে মুক্তি দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের পক্ষে লড়ে যাওয়া ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি চেয়ে যে আন্দোলন করছেন, আমি তাতে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। এ দাবির প্রতি যদি আমরা সমর্থন না জানাই, তাহলে আমরা মুক্ত গণমাধ্যমের যে কথা বলি, তা আবর্জনার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করা উচিত। এ দাবির প্রতি সমর্থন দিতে না পারলে আমরা যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কথা বলি বা যে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি, তা বর্জন করা উচিত।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যা বলেন এবং যে মতাদর্শে বিশ্বাস করেন, তার সবটাতে আমার সমর্থন নেই। ফরাসি জাগরণের জনক ভলতেয়ারের জীবন দর্শন চিত্রায়িত করতে গিয়ে তাঁর জীবনীকার ব্রিটিশ লেখক ইভালিন বিয়াত্রিস হল লিখেছেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত না–ও হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন দিতেও রাজি আছি।’
অ্যাসাঞ্জের ক্ষেত্রেও আমি একই কথা বলতে চাই। কারণ, অ্যাসাঞ্জ শুধু একজন ব্যক্তি নন। তাঁর মুক্তির সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মর্যাদার বিষয়টি জড়িত। যদি আমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ন্যায়বিচার ও ইনসাফ রেখে যেতে চাই, তাহলে সাংবাদিকদের ওপর আমরা যে সীমাবদ্ধতার দেয়াল তুলে দিয়েছি, তা সরিয়ে নিতে হবে এবং তাঁদের কাজের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার প্রধান বিরোধী নেতা