মতামত

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নেতৃত্ব দিতে হবে আসিয়ানকে

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রাধান্য দিতে হবে আসিয়ানকে
ছবি: এএফপি

কোভিড-১৯ মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে কতটা অরক্ষিত, সে বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে এই মহামারি হাসপাতালগুলোকে মর্গে পরিণত করে। একই সময়ে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই অঞ্চলের উপকূলীয় জনবসতিগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিকাশ এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতের জন্য কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমাদের শুধু কার্বন হ্রাসকরণের দিকেই নজর দিলে চলবে না, প্রকৃতিকেও রক্ষা করতে হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় খুব কম ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে। জীববৈচিত্র্য আমাদের খাদ্য, পানি, আশ্রয় এবং ওষুধের জোগান দেয়। এটা সামাজিক সংহতি এবং জলবায়ুর স্থিতিশীলতা আনে। পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষকে খাপ খাওয়াতে সহযোগিতা করে। যদিও আসিয়ানের ‘সমন্বিত পুনরুদ্ধার’ পরিকল্পনায় জীববৈচিত্র্য এখনো শুধু পাদটীকায় রয়ে গেছে। দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না আনলে সদস্যদেশগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের হাজার কোটি ডলার পানিতেই যাবে।

দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতের জন্য আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে অবশ্যই প্রকৃতি রক্ষার জন্য ‘তিরিশ-তিরিশ’ কর্মকৌশল বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করতে হবে। প্রস্তাবিত বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা কর্মকৌশলের (তিরিশ-তিরিশ) মূল বিষয়টা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে স্থলভাগ ও সমুদ্রের ৩০ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষণ করা। আশা করা যায়, এ বছরের মধ্যে এই কর্মকৌশলে বিশ্বের ১৯৬টি দেশ চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্বের মোট ভূমির ৩ শতাংশ নিয়ে গঠিত। কিন্তু বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ২০ শতাংশ এখানে। গত ২০ বছরে আসিয়ান অঞ্চলে দুই হাজারের বেশি নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনকে ‘বৃহৎ-বৈচিত্র্য’র দেশ বলা হয়। এখানকার জীববৈচিত্র্য আমাজনের বৃষ্টিবন এবং কঙ্গো অববাহিকার জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে তুলনীয়। বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবালপ্রাচীর এখানেই অবস্থিত।

যদিও আসিয়ানের দেশগুলো প্রাকৃতিক এই উত্তরাধিকার রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এরপরও ঝুঁকির মাত্রা পর্বতচুম্বী। ২০১৭ সালে আসিয়ান সেন্টার ফর বায়োডাইভারসিটির করা এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৭০-৯০ শতাংশ প্রাকৃতিক আবাস এবং ১৩-৪২ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সম্ভবত আমরা আমাদের উন্নয়ন ধারণায় জীববৈচিত্র্যের যে অমূল্য মূল্য, সেটা উপলব্ধি করতে পারছি না এবং এটাকে সংরক্ষণের যথাযথ ভূমিকার মর্মও বুঝতে পারছি না।

এই ক্ষতির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেও গুরুতর সংকট তৈরি হচ্ছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আসিয়ান অঞ্চলে জনসংখ্যা ৭২ শতাংশ বেড়েছে। কৃষি ও গৃহ নির্মাণ এবং খনি খননের কারণে দ্রুতগতিতে প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। এ বিষয়ে আসিয়ানের বক্তব্য, ‘এই অঞ্চলের জলাশয়, নদী ও তৃণভূমির উৎপাদনশীলতা এবং টেকসই গুণ ধারাবাহিকভাবে ক্ষয় হচ্ছে। উপকূল ও সমুদ্র এখানকার লাখ লাখ মানুষের খাবারের প্রধান উৎস। নির্বিচার মাছ শিকারের ফলে মৎস্যসম্পদ কমে যাচ্ছে, যা সমুদ্রের স্বাস্থ্য এবং খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি তৈরি করছে।’ সম্ভবত আমরা আমাদের উন্নয়ন ধারণায় জীববৈচিত্র্যের যে অমূল্য মূল্য, সেটা উপলব্ধি করতে পারছি না এবং এটাকে সংরক্ষণের যথাযথ ভূমিকার মর্মও বুঝতে পারছি না।

আসিয়ান দেশগুলো টেকসই অর্থনীতির নতুন পথ উন্মুক্ত করতে পারে। সমুদ্র ও জলাভূমিকে নিয়ে একটি প্রতিবেশগত সুরক্ষাবলয় স্থাপনে তারা পদক্ষেপ নিতে পারে। এই সুরক্ষাবলয় নির্দিষ্ট দেশের সীমানায় আবদ্ধ করে রাখা যাবে না। এই উদ্যোগ কার্বনসমৃদ্ধ বন ও তৃণভূমি, প্রবালপ্রাচীর এবং গভীর সমুদ্রতলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করবে। আমরা আদিবাসী ও স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে অক্ষত কিংবা ক্ষয়িষ্ণু বনভূমি ও তৃণভূমি রক্ষায় অভিভাবক বানাতে পারি। তাদের ওপর যে অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে করে তার ক্ষতি কিছুটা পূরণ হতে পারে। প্রকৃতির প্রকৃত রক্ষকদের যোগ্য সম্মান ও অধিকারও দেওয়া হবে।

আমার জন্মভূমি ফিলিপাইনের একটা ঘটনা এখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যাক। পালাওয়ান দ্বীপের ‘ক্লিওপেট্রার সুই’ নামের একটা এলাকার জীববৈচিত্র্য সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। ছয় বছরের প্রচেষ্টায় সেখানকার জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে আমরা সেখানকার প্রতি সেন্টিমিটার ভূমি এবং মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত বিচরণ করা প্রতিটি ধরনের প্রজাতির নাম নথিভুক্ত করেছি। শত শত বছর ধরে সেখানে বাস করা বাটাক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আমরা এ কাজগুলো করেছি। এই দৃষ্টান্ত আদর্শ মডেল হতে পারে। কিন্তু দ্রুত সময় ফুরিয়ে আসছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রকৃতি, দুর্যোগ এবং উন্নয়নের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কোভিড–পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অবশ্যই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রাধান্য দিতে হবে।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

টনি লা ভিনা ফিলিপাইনের ম্যানিলা অবজারভেটরির জলবায়ুনীতি বিষয়ে সহযোগী পরিচালক