২৪ এপ্রিল ছিল রানা প্লাজার সেই দুর্বিষহ ক্ষতের দিন। প্রায় তেরো শ শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন সেই ধ্বংসস্তূপে। আজীবন পঙ্গু হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছিলেন কয়েক হাজার শ্রমিক। সেই গভীর বেদনাকে মনে নিয়ে চোখ মেলতেই দেখি, লকডাউনের মধ্যে আবার রাস্তায় হাজার হাজার পোশাকশ্রমিক। নতুন করে আবার কারখানা খুলতে শুরু করেছে। রাত থেকেই বিভিন্ন উপায়ে দূর থেকে এসেছেন শ্রমিকেরা। তবে কোন কারখানা খোলা কোনটা বন্ধ, তা অনেকেই জানেন না। জানত না পুলিশসহ অনেকেই। তাই শ্রমিকদের ঢুকতে দেবে নাকি দেবে না, সে বিষয়টিও ঘোলাটে ছিল।
দুই দিন ধরে ঢাকা ও গাজীপুরে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। রাজধানীর মালিবাগে বিক্ষোভ করেন অনেকে। কেউ এসেছেন জীবিকা বাঁচাতে হবে, তা না হলে হয়তো ছাঁটাইয়ের মধ্যে পড়বেন। আবার কেউ এসেছেন বকেয়া বেতন আদায়ের চেষ্টা করতে। গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে সিটি করপোরেশনের ভোগড়া, টঙ্গী ও শ্রীপুর এলাকায় শ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছেন। আর ইতিমধ্যে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরোনো সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আমেনা গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা। লকডাউন উপেক্ষা করে ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত মাসদাইর-গাবতলী অংশে শতাধিক শ্রমিক ছাঁটাই না করার দাবিতে এই বিক্ষোভ করেন।
বাংলাদেশ এখন প্রায় লকডাউন অবস্থায়। রাস্তাঘাটে পুলিশ, আর্মি ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক লোকজনকে বাড়ি পাঠাচ্ছেন। সবাইকে ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও দেশ করোনামুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ছুটি থাকবে বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনা থেকে জীবন বাঁচাতে সবার জন্য যখন সাধারণ ছুটি, তখন অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আবার ‘খুচরা জীবনের’ মালিক হিসেবে সামনে আনা হলো পোশাক কারখানার শ্রমিকদের। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই সব ধরনের ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ কারখানা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের পোশাক খাতের মালিকেরা। সরকার ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে ২৬ এপ্রিল রাজধানীতে ৪০টি কারখানা খোলা ছিল। ২৭ এপ্রিল এর সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন ৬০টি কারখানা। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকার পরও এক সপ্তাহ ধরে অর্ধশতাধিক কারখানা চালু ছিল। বলা হয়েছে, খোলার ক্ষেত্রে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তা নিয়ে পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে। তবে এই গাইডলাইনে কী আছে, কিংবা সেটি শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছে কি না, সেটি কোথাও খোলাসা করা হয়নি।
শ্রমিকদের নিয়ে করোনাকালে টানাহেঁচড়া কম হয়নি। প্রথম দফায় ১০ দিন ছুটির পর কারখানা খুলে দেওয়ার কথা-চালাচালি হলে হেঁটে, ঋণ করে, ড্রামের মধ্যে লুকিয়ে ২-৩ দিন ধরে শ্রমিকেরা আসতে থাকেন ঢাকায়। তখন এটি নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই আবার বন্ধের ঘোষণা আসে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক শ্রমিক পৌঁছে গিয়েছিলেন ঢাকায়। কেউ আবার ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করেন, কেউ আটকা পড়েন।
আমাদের অর্থনীতি বাঁচা-মরার প্রাণ এই শ্রমিকেরা। আমরা এই সময়ে এসেও সেটির স্তুতি গেয়ে কারখানা খুলে দিচ্ছি। জ্বর পরীক্ষা ও হাত ধোয়ার মধ্য দিয়েই কী আমরা তাঁদের সুরক্ষার প্যাকেজটি বন্ধ করে কাজে আসতে বলছি? বাংলাদেশে এখনো অনেক পোশাক কারখানায় টয়লেট ১-২ টি। সেখানে কয়েক শ শ্রমিক কাজ করছেন। সেখানে কোনো শ্রমিক কাজ করতে এসে আক্রান্ত হলে তাঁর চিকিৎসার ভার কে নেবে? কোনো বিমা করা আছে? আর কোনো শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে তাঁর জন্য কী জুটবে? স্বাস্থ্য খাতের সেবকদের সমপরিমাণ বিমা কেন অর্থনীতির প্রধান চালকেরা পাবেন না?
মালিকপক্ষের কাছে দাবি, এই পরিস্থিতিতে তাঁদের যাতে ছাঁটাই না করা হয়। সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, সে ভিত্তিতে তাঁদের এপ্রিল মাসের বেতন যাতে মালিকপক্ষ দিয়ে দেয় এবং পুনরায় তাঁদের কাজে নেয়। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনার পরও কেন অনেক কারখানায় শ্রমিকেদের বেতন পরিশোধ করা হলো না? যারা দেয়নি, সেসব কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
অনেকেই বলছেন, শ্রমিকেরা কারখানা খোলার জন্য আন্দোলন করছেন। হয়তো সত্যি, কারণ এত দিনে তাঁরা জেনে গেছেন, হয়তো চাকরিটিই যাবে। তাই তাঁরা জীবন ও জীবিকার সীমানায় টালমাটাল হয়ে জীবিকার জন্য মাথা পেতে দেন।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail. com