শৈশবে মাঠে খেলতে গিয়ে ব্যথা পেলে ঘরে ফেরার পর দাদি বা নানি চুন-হলুদ মাখিয়ে দিতেন। কাপড় দিয়ে এক রাত বেঁধে রাখলেই ব্যথা উধাও হয়ে যেত। সর্দি-কাশি হলে প্রতিবেশী ফুপু বা খালা বাগান থেকে তুলসীপাতা এনে রস করে দিতেন। সেরে যেত সর্দি-কাশি। কেটে গিয়ে রক্ত পড়লেও সমস্যা নেই। বড় বোন হয়তো ছোট ভাইটির পায়ে লাগিয়ে দিতেন গাঁদা ফুলের পাতার রস।
সেসব দিন কবেই চলে গেছে। এখন আধুনিক যুগ। ব্যস্ত জীবন। কারও দিকে তাকানোর সময় নেই—কারও কথা মন দিয়ে শোনা তো দূর। দাদি বা নানিকে নাতি-নাতনিরা চেনেই না। ফুপু বা খালার সঙ্গে দেখা হয় কালেভদ্রে। আর প্রতিবেশীর সঙ্গে তো আলাপই হয় না। কোনো সমস্যায় পড়লে খুব প্রিয় বন্ধু বা কাছের কোনো স্বজনের কাছে ছুটে যাওয়া যায় না। দাবি নিয়ে আর বলা যায় না, শুনতেই হবে আমার কথা। সে যে তখন ভীষণ ব্যস্ত।
এখন আমরা ভেতরে-ভেতরে বড় একা। মনের কথা বলার সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে অনেকেই ভেতর ভেতর গুমরে মরেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারেন না। অনেকে হয়তো মানসিক চাপে ভুগতে ভুগতে মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। মানসিক চাপ বা ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বেড়ায় মানুষ। জীবনের এসব সমস্যা সমাধানে আজকের যুগে অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছে ইন্টারনেট, গণমাধ্যম।
পাঠক বা দর্শক-শ্রোতার আগ্রহের কারণেই আজকাল গণমাধ্যমে জীবনযাপনবিষয়ক খবর থাকে ভরপুর। হতাশা কাটাবেন কীভাবে? আত্মবিশ্বাস কীভাবে বাড়ানো যায়? দাম্পত্য, প্রেম থেকে শুরু করে জীবনের হেন সমস্যা নেই, যা গণমাধ্যমের জীবনযাপন অংশে পাওয়া যায় না। স্বাস্থ্যবিষয়ক টোটকাও থাকে প্রচুর। থাকে ফ্যাশন সচেতনতা। আগে যে কথা বন্ধু বা কাছের স্বজনকে অকপটে বলা যেত, সমাধান চাওয়া যেত, সে জায়গার অনেকটাই যেন লাইফস্টাইল সংবাদ নিয়ে নিয়েছে।
বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, এএফপি থেকে শুরু করে টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি—সব গণমাধ্যমেই মেলে এমন সব সংবাদ। বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোও ঝুঁকেছে এসব দিকে। অনলাইনে তো বটেই, পত্রিকাতেও এ ধরনের লাইফস্টাইল-বিষয়ক বিশেষ পাতা প্রকাশিত হয় প্রতি সপ্তাহে। এ ধরনের খবরগুলো প্রায়ই সর্বাধিক পঠিতের তালিকায় থাকে। টিভি চ্যানেলে টিআরপির হারও যায় বেড়ে।
জীবনযাপনবিষয়ক এত সব খবরের প্রভাব মানুষের ওপর কী রকম? এ রকম খবরের ভক্ত এমন কয়েকজনের কাছেই খোঁজা যাক উত্তর। জামিউর রহমান (ছদ্মনাম) অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী। তিনি জীবনযাপনবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখেন এবং কঠোরভাবে মানেন। মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। এমনকি চিকিৎসকের পরামর্শমতো কোলেস্টরেল কমানোর ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এর বদলে খান রসুন।
আবার অনেকে এই খবরগুলো শুধু মজা পেতেই পড়েন। কেউ আবার যেটা যৌক্তিক মনে হয়, কেবল সেটাই মেনে চলেন। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ফাতেমা চৌধুরী জানান, তিনি কেবল মজা পেতেই বন্ধুত্ব ও প্রেমবিষয়ক পরামর্শ পড়েন।
সাজগোজ, ফ্যাশন, ঘর গোছানো, রান্নাবিষয়ক টিপসগুলো অনেক নারীই পরখ করে দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সোনালী আহমেদ জানান, তিনি এগুলো একটি ডায়েরিতে টুকে রাখেন।
দেখা যায়, প্রতিদিনের কাজে লাগে—এমন বিষয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বেশি। আবার জীবনযাপনবিষয়ক খবরগুলো যেন একধরনের স্বাদের বদল। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত জীবন থেকে মানুষ একটু স্বস্তি খোঁজে। ভারী ভারী খবর, যার বেশির ভাগই দুঃসংবাদ, তা মানুষকে হাঁপিয়ে তোলে। জীবনযাপনের খবর যেন একমুঠো রোদ্দুর। একঘেয়েমি কাটানোর রসদ।
শোনা যাক মনোবিশারদের মতামত। এমন আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, জীবনযাপনবিষয়ক সব খবরেই ভালো থাকার চাবিকাঠি থাকে। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য যে মাধ্যমেই বলি না কেন, মূল বিষয়টি হলো কীভাবে আরও ভালো থাকা যায়? কীভাবে যন্ত্রণা এড়ানো যায়। মূলত ভালো থাকার বা সুখে থাকার ইচ্ছে থেকেই মানুষ এ ধরনের খবর খুঁজে বেড়ায়।
ভালো থাকা বা সফলতা কে না পেতে চায়? এ কারণেই হয়তো আয়মান সাদিকের ইউটিউব চ্যানেল ‘টেন মিনিট স্কুল’ এতটা জনপ্রিয়। ২৮ জুনের হিসাব অনুযায়ী এর সাবস্ক্রাইবার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫০৮ জন।
মানুষের এই আগ্রহ বা নির্ভরতার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা উচিত গণমাধ্যমগুলোরও। শুধু ক্লিক, সার্কুলেশন বা টিআরপি বাড়াতে নয়, গণমাধ্যমগুলোকে হতে হবে দায়িত্বশীল। জীবনযাপনবিষয়ক টিপসগুলো যিনি লিখবেন, তিনি যেন যথেষ্ট খোঁজখবর করেই লেখেন। অর্থাৎ তাঁর লেখায় যেন কোনো ভুল তথ্য না থাকে। কোনো ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকলে সেটিও যেন তিনি লিখে দেন। আরও একটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনো বিষয় নিয়ে না লেখাই ভালো।
আমরাও যেন একটু সচেতন থাকি। মনে রাখতে হবে, এক জিনিস বারবার পড়লে একধরনের প্রভাব থাকেই। প্রভাব থাকাটা ক্ষতিকর নয় কিন্তু জামিউর রহমান নামের ওই ভদ্রলোকের মতো আসক্তি যেন না পেয়ে বসে। আমরা অবশ্যই খবর পড়ব কিন্তু কতটা কাজে লাগাব, কতটা আমার নিজের জন্য উপযোগী, এর বাছবিচারটা করতে হবে নিজেকেই। সুখের খোঁজে সোনার হরিণের পেছনে যেন আমরা না ছুটি। যেন ঘর থেকে দুই পা দূরের ধানের শিষের ওপরে শিশিরবিন্দুর সৌন্দর্য আমাদের চোখ এড়িয়ে না যায়।