এক বাটি আলু-পটলের তরকারি, একটু পাতলা ডাল আর এক শানকি ভাত। মূল্য ৮০ টাকা। সাইফুল ইসলামের খুব ইচ্ছে হয় পেটপুরে ভাত খেয়ে পরান ঠান্ডা করতে। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীর চাকরি। একে তো মাইনে বাড়ে না দুই বছর, অন্যদিকে এই চাকরি কখন যায়, আর কখনবা থাকে, তা ভেবে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয় তাঁকে। তবু কয়দিন আগেও দুপুরে ভাত খেতে পারতেন তিনি। এখন ১০ টাকায় রুটি আর ১০ টাকায় একটি কলা—এই ২০ টাকায় দুপুরের খাবার সমাধা করতে হচ্ছে তাঁকে।
কারণ বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন ৫০০ টাকা, সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার রিকশাভাড়া বেড়েছে, নিজের বিক্রয়কর্মীর কাজ, এখানে-ওখানে যেতে হয়, বেড়েছে বাসের ভাড়া। এর ওপর চাল, তেল, ডাল, চিনি, সাবান, টুথপেস্ট, টিস্যু পেপার, কোন জিনিসটার দাম বাড়েনি! ধারকর্জই বা কত আর করা যায়। সাইফুলরা তাই দুপুরে কলা-রুটি খেয়ে সংসারের খরচ কিছু সাশ্রয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বড্ড কঠিন সময় পার করছেন দেশের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষেরা। এমন একটা সময়ে এ কঠিন অবস্থা নেমে এসেছে যখন বাংলাদেশ পার করেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কাগজ-কলমের হিসাবে বেড়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ও, যা এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার।
একই সঙ্গে সমাজে বেড়েছে বৈষম্য, অর্থনীতিবিদদের কথায়, যার জন্য দায়ী কোভিড পরিস্থিতি। কোভিডকে দায়ী করে আমরা সান্ত্বনা খুঁজতে পারি, কিন্তু বৈষম্য তো এ সমাজের শরীরে জড়িয়ে থাকা শত বছরের অলংকার।
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে দরিদ্র নগরবাসীদের বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! তাদের বেড়ে থাকা রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার মতো আরও কিছু খবর সামনে আসতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। পাঁচটি বিতরণ কোম্পানি গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর নতুন যে প্রস্তাব এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে দিয়েছে, তা বর্তমান মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ।
খবরটি শুনে কারওয়ান বাজারে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বলছিলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে দুই বা তিন সদস্যের একটি পরিবারের বাসায় চুলো জ্বালিয়ে রান্না না করে হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খাওয়া বেশি লাভজনক হবে। এত টাকা গ্যাসের বিল দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
যদিও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন দাম বৃদ্ধির সেই প্রস্তাব পরে ফেরত পাঠায়।
গ্যাসের পর আবার পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। যে ওয়াসার পানির মান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে, কয়েক মাস আগে জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ওয়াসার সরবরাহ করা হলুদ রঙের পানি জগে ভরে এমডি তাকসিম এ খানের দপ্তরে এসেছিলেন তাঁকে দেখাতে, তাকে শরবত বানিয়ে খাওয়াতে। মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়েছিল খবরটি।
পানির মানের কি কোনো উন্নতি হয়েছে? উত্তর হলো, হয়নি। সরবরাহ ঠিক না করে, মান না বাড়িয়ে আবার পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে ঢাকাবাসীর পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল তাদের, তারপর নাকি বোর্ড সদস্যদের ‘আপত্তি’তে ২০ শতাংশ ছাড় দিয়েছেন মহাক্ষমতাধর এমডি। পানির দাম বাড়ানোর এই অপচেষ্টা সফল হলে এটা হবে গত তিন বছরে তিনবার বৃদ্ধি। গত ১৩ বছরে যা ১৬ বার। অর্থাৎ প্রতিবছরই পানির দাম বাড়ায় ওয়াসা। জুলুমের শিকার হওয়া থেকে একবারও নিস্তার নেই নগরবাসীর!
সামনে আরও বেদনার দিন আসছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি ইংরেজি পত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, এপ্রিলের শুরুতে রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য—ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর, চিনির মূল্য বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো, দেশে নাকি এসব পণ্যের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে আসা তথ্য তা-ই বলছে। খুচরো ব্যবসায়ীরা কেবল একটু বেশি চাহিদা দিচ্ছেন। জিনিস দোকানের গোডাউনে একটু জমা করে রাখতে চাচ্ছেন তাঁরা। এতেই ছোলা-খেজুরের দাম বাড়ার নর্তন-কুর্দন শুরু হয়ে গেছে।
চারদিকে এই বাড়তি ব্যয় কীভাবে সামাল দেবে মানুষ! বিধিনিষেধে চাকরি হারিয়ে যুবকের আত্মহত্যার খবর আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। আর কোনো তরুণকে সেদিকে ঠেলে দেওয়ার পথ যেন আমরা তৈরি না করি। দুপুরে ভাতের বদলে সাইফুল ইসলামদের কলা-রুটি খাওয়ার বন্দোবস্ত অন্তত থাকুক।
জীবনযাত্রার এই ব্যয় বৃদ্ধিতে মানুষ সংকটে পড়লেও রাজনীতিবিদদের যেন কিছু আসে-যায় না। তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। কোনো হেলদোল, উচ্চবাচ্য নেই।
মানুষের স্বার্থে একটা-দুটো কথা কারও মুখ থেকে বের হচ্ছে না বললেই চলে। খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানোর কথা তাঁরা বলতে পারতেন। এই পণ্য নিতে সব কাজ ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, বিকল্প কী ব্যবস্থা করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা কথা বলতে পারতেন। বাজার তদারকি নিয়ে নানা কথা আছে। এ কাজটি আরও দক্ষতার সঙ্গে কীভাবে করা যেতে পারে, তা নিয়েও ভাবা যেত। কিন্তু মানুষের স্বার্থে কোনো ভাবনাই রাজনীতিবিদদের মাথা থেকে আসছে না। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাজনীতিবিদেরা যেভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন, এর পরিণতি ভালো নাও হতে পারে।
কাজী আলিম-উজ-জামান, প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক