জি-৭–এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে

জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে জি–৭ নেতাদের মুখোশ পরে সমুদ্রে নেমে পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভ। সেন্ট ইভস, কর্নওয়াল, ইংল্যান্ড।
ছবি: এএফপি

জি-৭–এর সদ্য সমাপ্ত সম্মেলন ছিল সম্পদের অপচয়। অনলাইনেই এটি আয়োজন করা যেত। এতে সময়, খরচ ও উড়োজাহাজের জ্বালানি বাঁচত। মূলত জি-৭–এর সম্মেলন তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। বিশ্বনেতাদের উচিত এর পেছনে শক্তিক্ষয় বন্ধ করা। কারণ, এ সম্মেলন বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে না। এটির লক্ষ্য ও তা পূরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে তেমন সংযোগ নেই।

জি-৭ সম্মেলনে এমন আহামরি কিছু ছিল না যে যা আরও সহজভাবে, একেবারে কম খরচে ও জুমের মাধ্যমে এর আয়োজন করা যেত না। এ বছরের অন্যতম ফলপ্রসূ কূটনৈতিক বৈঠকটি ছিল ৪০ দেশের নেতাদের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক। এপ্রিলে বাইডেনের সেই বৈঠক ছিল অনলাইনে। বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, বিজ্ঞানী ও অ্যাকটিভিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলো অনলাইনেই হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার বিষয়টি তারা সহজ করে তুলেছে।

জি-৭ এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কারণ, এর নেতারা কোনো প্রতিশ্রুতি দেন না। তাঁরা প্রতীকী বিবৃতি দিতে পছন্দ করেন, কোনো সমস্যার সমাধান নয়। বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করছেন এমন ভাব দেখালেও, সমস্যাগুলোকে আরও পচনশীল জায়গার দিকে ঠেলে দেন তাঁরা। এ বছরের সম্মেলনও কোনো পার্থক্য ছিল না

জি-৭ সম্মেলনের আলোচনাগুলোকে জি-২০ রহিত করে দিয়েছে। যখন জি-৭ দেশগুলো, মানে কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭০–এর দশকে তাদের বার্ষিক সম্মেলন শুরু করে, তখনো তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির আধিপত্য করে। ১৯৮০ সালে বিশ্বের সর্বমোট জিডিপির ৫১ শতাংশই ছিল তাদের, সেখানে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এসে জি-৭ দেশগুলোর সেই জিডিপি এখন ৩২ শতাংশ আর একই এশীয় দেশগুলোর হচ্ছে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ।

চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে জি-২০ জোট এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির মোট জিডিপির ৮১ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। বেশি আয় করা দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য করে জোটটি। তবে এরপরও সেটি যথেষ্ট নয়। কারণ, এটি ছোট অর্থনীতির ও গরিব দেশগুলোকে বাইরে রেখেছে। তাদের উচিত আফ্রিকান ইউনিয়নকেও (এইউ) সদস্য বানিয়ে নেওয়া। তাহলে প্রায় গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকে তাদের ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। জি-৭ জোট যে লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বার্ষিক আলোচনাতেই সম্ভব।

জি-৭ এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কারণ, এর নেতারা কোনো প্রতিশ্রুতি দেন না। তাঁরা প্রতীকী বিবৃতি দিতে পছন্দ করেন, কোনো সমস্যার সমাধান নয়। বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করছেন এমন ভাব দেখালেও, সমস্যাগুলোকে আরও পচনশীল জায়গার দিকে ঠেলে দেন তাঁরা। এ বছরের সম্মেলনও কোনো পার্থক্য ছিল না।

কোভিড-১৯–এর টিকার কথা ধরুন। বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যাকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেন জি-৭ নেতারা। কিন্তু দিলেন ৮৭ কোটি ডোজ টিকার প্রতিশ্রুতি, যা দিয়ে এক ব্যক্তির জন্য দুই ডোজ ধরে সাড়ে ৪৩ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ হচ্ছে ৪০০ কোটি ৭০ লাখ মানুষ, যা টিকা পেতে যাওয়া মানুষের ১০ গুণের মতো। জি-৭ নেতারা তাঁদের বর্ণিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো পরিকল্পনাই হাজির করেননি।

জি-৭–এর আরেকটি মিথ্যা প্রতিশ্রুতির উদাহরণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। সর্বশেষ সম্মেলনে জি-৭ নেতারা ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর লক্ষ্য ঠিক করেছেন, সেই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও একই আহ্বান করেছেন। কিন্তু এর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে অর্থায়নের পরিকল্পনা না করে ২০০৯ সালে প্রথম করা একটি আর্থিক প্রতিশ্রুতি তাঁরা ফিরিয়ে এনেছেন। সেই প্রতিশ্রুতির ১০ হাজার কোটি (প্রতিবছরে) ডলারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সময়সীমা ছিল ২০২০ সাল পর্যন্ত। সেটি তাঁরা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান এবং প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অবশ্যই জি-৭ সম্মেলনের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে এখনো। কারণ, মহামারির ইতি টানা, জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় কার্বন নিঃসরণ কমানো, শিশুদের স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মতো বৈশ্বিক দাবিগুলো জরুরিভাবে পূরণ করতে হবে আমাদের। আমার পরামর্শ হচ্ছে, মুখোমুখি বৈঠক কমিয়ে হোমওয়ার্কের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া, জুম মিটিং বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা শেষ করা এবং জি–২০–এর (ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ) ওপর বৃহত্তর স্বার্থে আস্থাশীল হওয়া। সত্যিকার অর্থে যেকোনো সমাধানের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাকে এক টেবিলে নিয়ে আসতে হবে আমাদের।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক