মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার এক নারী সাগর মণ্ডল নামের মধ্যবয়সী এক লোকের জিব কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তা কী করছিলেন সাগর মহাশয়? বিয়েবাড়িতে হইহল্লার সুযোগে ওই নারীকে ধর্ষণ করতে গিয়েছিলেন। নিরুপায় নারী নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে নিজের শেষ অস্ত্র দুপাটি দন্তের আশ্রয় নেন। তারপর যা ঘটল, তা রটে গেল সংবাদমাধ্যমে। প্রথম আলো অনলাইনের পেজে ৩ মার্চ প্রকাশিত সেই খবরের শিরোনাম ‘নিজেকে রক্ষা করতে ধর্ষকের জিব কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেন নারীটি’।
ওই নারীর ভাষ্য, তাঁর স্বামী বিদেশে থাকার সুযোগে সাগর এক বছর ধরে নানাভাবে তাঁকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও জানানো হয়। সোমবার রাতে তাঁকে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন সাগর। নিজেকে রক্ষা করতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন তিনি। একপর্যায়ে সাগরের জিব কামড় দিয়ে কেটে ফেলেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য, ওই দিন ঘটনাস্থলে একটি বিয়ের আয়োজন চলছিল। সেখানে সাউন্ড বক্সে জোরে গান বাজছিল। দিবাগত রাত একটার দিকে ওই নারী নিজের ঘরে যাচ্ছিলেন। এ সময় সাগরও তাঁর ঘরে ঢুকে যান। নারীটি চিৎকার দিলেও গানের শব্দের তা চাপা পড়ে। এ সময় নিজেকে রক্ষা করতে সাগরের জিবে কামড় দেন ওই নারী। জিব থেকে ইঞ্চিখানেক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাগর এখন কোনো এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
প্রতিদিনই অপ্রিয় নানা খবর পড়ি। খুন-জখম, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট আর নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর খবর রোজকার ডালভাতের মতো গিলি। ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনা একটা দিনও বাদ যায় না। এ নিয়ে নানা প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু মানুষ হইচই করে। তারপর সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আইনি প্রক্রিয়ার ঢিমেতেতালার আবর্তে ঘুরপাক খায় বিচার।
ধর্ষণ বা এ ধরনের জোরজুলুমের খবরে এর আগে নারীর প্রতিরোধের নানা ঘটনা পেয়েছি। চেলাকাঠ দিয়ে পেটানো, বঁটি দিয়ে কোপানো, পুরুষাঙ্গ কর্তন ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে জিব কামড়ে ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা এটাই বুঝি প্রথম। অন্তত আমার কাছে। এখানে এই নারী যেভাবেই হোক, নিরুপায় হয়ে শারীরিক অস্ত্র প্রয়োগে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন। আইন হয়তো তার ধারা অনুযায়ী তাঁকে সমর্থন দেবে না, কিন্তু ওই মুহূর্তে একটা নরশার্দূল থেকে নিজেকে রক্ষা করাটা জরুরি ছিল। তিনি যেভাবেই হোক, আত্মরক্ষা করেছেন। এটাই বড় কথা। তিনি শুধু এক সাগরের জিব কেটেছেন, তা নয়; তাবৎ ধর্ষক অপোগণ্ডের জিবের ডগা কেটেছেন।
জিবের জোরেই মানুষ কথা বলে। জিবের অসতর্কতায় বেফাঁস কিছু বেরিয়ে গেলে প্রাণ যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। জিব হচ্ছে মানুষের লালসা আর লোভের প্রতীক। উপাদেয় খাবার দেখলে জিব উতলা হয়। পানি এসে যায়। তেমনি মানুষের মনের ভেতর থাকে এমন এক জিব, তা সংবরণ করা যে মানবিক দায়িত্ব এবং আবশ্যক, এই জিবকর্তনের ঘটনায় তা জাজ্বল্যমান।
সমাজটা আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? ধর্ষণের ঘটনা তো অহরহই ঘটছে। প্রায় ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা। সমাজের অনেকেরই মানসিকতা এতটাই নিচে নেমেছে যে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে নারীকে কেবল ভোগের পণ্য হিসেবে দেখে তারা। এমন প্রেক্ষাপটে এই জিব কাটার ঘটনায় সমাজে ধর্ষণ পরিস্থিতির হীন চিত্রটিই যেন ফুটে উঠেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২। অর্থাৎ ২০১৯ সালে আগের বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ।
ওই নারীর কথা যদি বলি, তিনি ধর্ষকামী পুরুষের জিব কেটে নিজেকে রক্ষা করলেও পাশাপাশি গঞ্জনাও হয়তো আসবে। এই চিরচেনা সমাজের রূপটা তো সবারই চেনা। ঘুরেফিরে শেষে লাটাই ঘোরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজপতিদের হাতে। কিন্তু তাঁকে সাহস হারালে চলবে না। মনোবলে শক্ত থাকতে হবে। তেমনি সমাজের কল্যাণকামী মানুষকেও প্রকৃত বন্ধুর সহমর্মিতা নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, সব মানুষের একটি সুন্দর সহাবস্থানের সমাজ গড়ার দায়িত্ব সবার।
নিজের জিব হারিয়ে সাগর গোটা পুরুষ জাতির মাথা কেটে যে ঘৃণার সাগরে পড়েছেন, সেখানে কোনো ধিক আর ধরবে না। জিব হারালে একটি মানুষের কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে যায়। তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, নির্বাক–নীরব দহনে জ্বলবেন নিজের কৃতকর্মের জন্য।
বাঙালির চিরায়ত লোকসংস্কৃতিতে বর্ণিত রয়েছে, অনেক আগে লীলাবতী নামের এক সত্যবাদী নারী ছিলেন। শেষে এই সত্য বলাটাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী সে নারীর জিব কেটে দেন। তবে আমৃত্যু লীলাবতী সত্যের প্রতীক হয়ে ছিলেন। তিনি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, যা হুবহু ফলে যেত। সেই লীলাবতী পরে ‘খনা’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙালি লোকসংস্কৃতিতে এখনো অমৃতবাণীর মতো খনার বচনের প্রচলন রয়েছে।
খনা জিব হারিয়ে ছিলেন সত্যবাদী বলে। আর ধর্ষকামী সাগর জিব হারালেন কলঙ্কের সাগরে নেমে। এখন তিনি অবশ্য বসে বসে সুবচন লেখার চেষ্টা করতে পারেন। অন্তত এ কথা তো লিখতেই পারেন, ‘ধর্ষণ করতে গেলে জিব খোয়া যেতে পারে!’
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও লেখক
shariful.bhuiyan@prothomalo.com