জাহালম ফিরলেন, অন্য সবাই কি ফিরতে পারবেন?

এক জাহালম তো ফিরলেন, কিন্তু গায়েবি মামলা, গুম-অপহরণের শিকার কত কত জাহালম এখনো ফেরেননি। যেমন আর ফিরবেন না কক্সবাজারের কমিশনার একরামুল। খরচযোগ্য এসব মানুষকে অবলীলায় খরচ করে দেওয়া যায়। জাহালমের শিশুকন্যা চুমুতে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে বাবাকে, মা দুধে গোসল করিয়ে ঘরে তুলেছেন তাঁর আদরের পোলাকে; অন্যদিকে গুম-নিখোঁজের শিকার কত বাবার জন্য কত সন্তানের অশ্রুদরিয়া এখনো উথালপাতাল।

ছাত্র আন্দোলন করার দায়ে কিছুকাল নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো জেলে ছিলাম। দেখেছি, বিনা বিচারে বছরের পর বছর ঝুলে থাকা নিঃশেষিত মানুষ। কত হাজতি দেয়ালে মাথা ঠুকছেন, কতজন আত্মহত্যা করতে চাইছেন। জেলখানার গরাদের ভেতর সিনিয়র কয়েদিরাই বস। তাঁদের টাকাপয়সা দিয়ে খুশি করতে না পারলে জীবিত থেকেই নরকের স্বাদ মিলত। খাবার জুটবে না, ঘুমানোর জায়গা মিলবে না, টয়লেট চেপে বসে থাকতে হবে। শক্তিমানদের সেখানে রাজার মতো সেবা করতে হয়। অল্পবয়সীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। জেলপুলিশের নির্দয় কাজকারবার তো আছেই। গাইবান্ধার একদল রিকশাচালককে পেয়েছিলাম, পুলিশের গণগ্রেপ্তার অভিযানে তঁাদের ধরে আনা হয়েছিল। তখনো মোবাইল ফোন আসেনি। তাঁরা ছিলেন গরিবস্য গরিব, প্রাণী থেকে সামান্য উঁচুতে উঠতে পারা মানুষ। জেলে পচে মরা ছাড়া তঁাদের কিচ্ছু করার ছিল না। কে তঁাদের বাড়িতে খবর দেবে, কে উকিলের পয়সা গুনবে। হয়তো তাঁদের অনেকের পরিবার জানতেও পারবে না আপনজনেরা কীভাবে কোথায় হারিয়ে গেলেন বা খরচ হয়ে গেলেন!

নিরপরাধ অবস্থায় জেল না–খাটা কেউ জাহালমের ওই তিন বছরের দুঃখ জানবেন না। অপরাধীর তবু তো সান্ত্বনা থাকে যে দোষ করেছি তাই ভুগছি; কিন্তু নিরপরাধ নিজে বা তাঁর পরিবার মনকে কী বুঝ দেবেন? কেন তাঁদের জীবন এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো?

মাকে খুনের অভিযোগে সাভারের এক দিনমজুর যুবককে আনা হয়েছিল। কথা বলতেন খুব কম। আমাকে বলেছিলেন, সম্পত্তির দখল নিতে মামারা তঁার মাকে খুন করে তাঁকে নাকি ফাঁসিতে চড়াবার ব্যবস্থা করেছেন; যাতে কোনো ওয়ারিশ না থাকে। এক তরুণ দম্পতিকে পেয়েছিলাম, খুনের আসামি হিসেবে ছেলেটি পুরুষ ওয়ার্ডে আর মেয়েটি নারী ওয়ার্ডে কয়েদ খাটছিলেন। শুক্রবার করে তাঁদের দেখা করার সুযোগ হতো। ছেলেটি আমির খানের মতো চেহারা নিয়ে যতটা পারেন সেজেগুজে মেয়েটিকে দেখতে যেতেন। বিকেএসপির এক তরুণ খেলোয়াড় আর তাঁর ভাই জেল খাটছিলেন বিচারাধীন অবস্থায়। তাঁদের বাবাও সেখানে ছিলেন, কিছুদিন আগে তাঁর জামিন হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন ছিলেন স্রেফ পথচারী। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ভুল পুলিশের সামনে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা।

তাঁদের মধ্যে কতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার মতো, কতজন অন্য কারও অপরাধের বদলি খাটছেন কে বলতে পারে? মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল কয়েক দিন আগে বলেছেন, দেশের জেলখানাগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বিনা বিচারে আটক রয়েছে। এদের মধ্যে বড় সংখ্যক একটা মানুষ কোনো অপরাধ না করেই জেল খাটছেন। 

জানুয়ারি মাসে জনৈক তারা মিয়ার নাম খুব ফাটল। সুনামগঞ্জের অধিবাসী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তারা মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে নাশকতার। কঞ্চির মতো হাত-পা বাঁকানো এই ভিখিরি মানুষটিকে ভুয়া মামলার বিরুদ্ধে সংশপ্তকের মতো লড়তে হচ্ছিল। অনেক লেখালেখির পর তারা মিয়ার ছয় সপ্তাহের জামিন হলেও মোহাম্মদপুরের আতরের দোকানি ‘হাতকাটা’ ইউসুফের খবর জানা যায় না। আদালতপাড়ায় ভিড় করে আসছে শত শত মানুষ—গায়েবি মামলার সত্যিকার সব মানুষ। বেশির ভাগই গ্রাম-শহরের গরিব মানুষ। কেউ বর্গাচাষি, কেউবা ছাত্র, কেউবা দিনমজুর, কেউবা কোনো কিছু নয়। ৮১ বছরের অন্ধ বৃদ্ধের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে নাশকতার। প্রথম আলো জানিয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেড় মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ১৮২টি গায়েবি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জড়ানো হয়েছে ৮৮ হাজার নাগরিকের নাম।

গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচনী হাওয়া ওঠে রাজনীতিতে। তার পরের দেড় মাসে যদি ৮৮ হাজার জনের নামে মামলা হয়, তাহলে নির্বাচনের আগে-পরের দেড়+দেড় তিন মাসে কতজনের নামে মামলা হয়েছে? ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়েও এমন হয়েছে। এমনই হয়ে থাকে।

এ রকম গায়েবি মামলার শিকার কত ভাগ নিরীহ মানুষ? জানব কীভাবে? যদি দুদক ভুল করে, যদি সরকারের মন্ত্রী দাবি করেন ‘গায়েবি মামলা বলে কিছু আমাদের অভিধানে নেই’, যদি রাষ্ট্র তার অনেক মানুষকে নৈনাগরিক ভাবে, তাহলে মানুষ কার কাছে বিচার দেবে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্যামপুরের বর্গাচাষি বৃদ্ধ মিলন মিয়া বলেছেন, ‘ওপরের উনি সব দেখছেন’।

জেলখানা আইনে নাগরিকদের পক্ষ থেকে কারা পরিদর্শনের সুযোগ আছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী প্রমুখ নির্দিষ্ট শর্তাধীনে কারাগারে গিয়ে হাজতি ও কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন দিতে পারেন। মানবাধিকার কমিশনও এটা পারে। তাঁরা কি আমাদের জানাবেন, মোট কারাভোগীদের মধ্যে জাহালমরা কত ভাগ, কত ভাগ শাস্তির মেয়াদের চাইতে বেশি দিন জেলবাসী? কত ভাগ বিনা বিচারে আটক, কত ভাগ ভুল মামলার ভুল আসামি? গায়েবি মামলার আসামিদের কারা বিনা দোষে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন? চলমান সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নটারই বা কী হবে: জাহালম কি ক্ষতিপূরণ পাবেন? যাঁদের কারণে জাহালমকে জেল খাটতে হলো তাঁরা কি শাস্তি পাবেন?

উৎপল দত্তের বিখ্যাত টিনের তলোয়ার নাটকের সংলাপ, ‘আর সেই পুলিশ এমনই পুলিশ, আসামিকে কিচ্ছু বলে না, আমাদের ধরে নিয়ে যায়।’ সেটা ব্রিটিশ আমলের কাহিনি। ব্রিটিশের পরে পাকিস্তানি শাসকেরাও এসেছে আর গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও অবস্থার খুব বদল হয়েছে কি?

রোমান সাম্রাজ্যের আইনে একধরনের মানুষ ছিল, যাদের বলা হতো ‘হোমো সাসের’। তারা স্বাধীন নাগরিকও ছিল না, আবার তাদের দাসও বলা যেত না। তাদের হত্যায় অপরাধ হতো না। আত্মপক্ষ সমর্থনের যোগ্যতা ছিল না তাদের। তাদের মৃত্যু কখনো পবিত্রতার মর্যাদা তথা শহীদি সম্মান পেত না। বাংলাদেশে আজ অনেক মানুষ ক্রমেই দুর্ভাগ্যের হোমো সাসের দশায় পড়ে গেছে। জাহালম হওয়ার ঝুঁকিতে অনেকেই। এই-ই কি আমাদের প্রাপ্য ছিল?

ফারুক ওয়াসিফ : প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
faruk.wasif@prothomalo.com