জালবন্দী কাক, জলবন্দী মানুষ

বছর দু-এক আগে রংপুর শহরে আর কে রোডের পাশে একটি উঁচু গাছের ডালে কীভাবে যেন একটি জালের ব্যাগের সঙ্গে পা জড়িয়ে আটকা পড়েছিল একটি কাক। কাকের বিপদে কাক যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, তা মানুষের জন্য শিক্ষণীয়। কাকের কা কা ধ্বনির আহাজারি মানুষের মনেও সহানুভূতি জাগিয়েছিল। সহকর্মী অধ্যাপক মতিউর রহমান বলছিলেন ফায়ার সার্ভিস অফিসে খবর দেওয়ার জন্য। উঁচু গাছের চারদিক হাজার হাজার কাকের রঙে কালো হয়ে উঠেছিল। কাক চেষ্টা করেছে বিপদগ্রস্ত একটি কাককে বাঁচানোর জন্য।

মানুষ বিপদে পড়লে মানুষ কি এত আকুতি নিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়? চলতি মাসের মাঝামাঝি যে বন্যা হলো, এ বন্যায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অর্ধকোটি মানুষের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষতি সামলে উঠতে পারবেন। আর যারা পারবেন না, তাঁদের পাশে দেশের সামর্থ্যবান মানুষেরা দাঁড়ালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা যেত অনায়াসে।
অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এ বছর বন্যার ভয়াবহতা অনেক বেশি। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগে অসহায় বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাঙালি অনেকেই হাত প্রশস্ত করেছেন অসহায়দের অসহায়ত্ব লাঘবে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ক্ষতি সামলে ওঠার পক্ষে খুবই নগণ্য।
রংপুর থেকে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী, রংপুর থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী, রংপুর থেকে দিনাজপুর, রংপুর থেকে লালমনির হাটের বিভিন্ন উপজেলা পর্যন্ত কোথাও ফসল নেই। বন্যা হওয়ার আগে এসব ছিল সবুজের সমারোহে ভরপুর। এখন মৃত ধানখেত, সবজিখেত। এসব খেতের মালিকদের মুখ এখন মলিন, করুণ। যাঁরা মালিক নন, এসব ফসলের শ্রমিক, তাঁদেরও উপার্জনের পথ বন্ধ। তাঁরা হতাশ। এই জনপদ এখন বিপর্যস্ত জনপদ। লাখ লাখ ঘর ভেঙে গেছে বন্যার স্রোতে। শণের ঘর এখন এদিকে পাওয়া যায় না। এনজিও চড়া সুদে ঋণ দিয়ে টিনের ঘর তোলার ব্যবস্থা করেছে। এ জনপদের লাখ লাখ মানুষ আবারও দ্বারস্থ হবে ঋণ নেওয়ার জন্য। যত দিন ঋণ শোধ হবে না, তত দিন না খেয়ে হলেও ঋণ পরিশোধের কাজে থাকবে ব্যস্ত। বলা যায়, দীর্ঘ কষ্টের দুষ্টচক্রে পড়ল এখানকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
গত শুক্রবার ত্রাণ দেওয়ার কাজে গিয়েছিলাম কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলায়। যাওয়া-আসার পথে দেখলাম একখানে বিস্কুটের কার্টন দেওয়া হচ্ছে। আর এক স্থানে দেখলাম সিমেন্টের চুলা দেওয়া হচ্ছে। একটি ট্রাকের পাশে অনেক মানুষের ভিড়। ট্রাকে সাদা বস্তায় চাল-ডাল আছে বলে মনে হলো। ভূরুঙ্গামারীর দুধকুমর নদীতে বাড়ি ভেঙে যাওয়া মানুষদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণকালে বয়সে জবুথবু আরজিনা বেগম ত্রাণ পেয়ে খুব খুশি। কতবার ত্রাণ পেলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, ‘বাবা আগে একবারও পাংনাই।’ বাড়ি কত দূরে জানতে চাইলে বলেন, ‘বাড়ি তো নাই বাবা। ভাঙি গেইচে। মাইনেসর বাড়িত আছি।’ মনে হলো ত্রাণ পেয়ে যেটুকু খুশি হয়েছিলেন তিনি, বাড়ির প্রসঙ্গ তুলতেই তা নিভে গেলে।
সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে বন্যায় গৃহহীন মানুষের একটি তালিকা করে অনলাইনে প্রকাশ করা প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, সরকারি-বেসরকারিভাবে যাদের বাড়ির ব্যবস্থা হবে, তাদের সাহায্য প্রাপ্তির পরিমাণও যদি উল্লেখ করা যেত, তাহলে যারা ত্রাণ পায়নি, তাদের পাশে অনেকেই দাঁড়াতে পারতেন। এখন যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তা অনেকটা আত্মতুষ্টির জন্য। ভয়াবহ ক্ষতি দূর করতে পারব না জেনেও পঞ্চাশ-এক শ-হাজার টাকা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টামাত্র।
ত্রাণকাজে সমন্বয়হীনতা আছে। এমনও হয়েছে, কেউ হয়তো কয়েকবার ত্রাণ পেয়েছেন, কেউ হয়তো একবারও ত্রাণ পাননি। দুর্গম এলাকায় কেউ ত্রাণ নিয়ে যেতে চায় না। আবার ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা না থাকলে অসুবিধারও ভয় আছে। যেসব এলাকায় আগে সহজে যাওয়া যেত, বন্যার ভাঙনে তার অনেক স্থানে আর যাওয়া যায় না। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী-ভূরুঙ্গামারীর অনেক স্থানেই সড়ক ভেঙে যাওয়ার কারণে অনেকখানি পথ ঘুরে আমরা ট্রাক নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। একপর্যায়ে ট্রাক থেকে ত্রাণ নামিয়ে অটোরিকশায় করে নিতে হয়েছে। যে মাইক্রোবাস ভাড়া করেছি, তার ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছে ভাড়ার সঙ্গে। এত দুর্গম এলাকায় অনেকেই যেতে চান না।

ত্রাণের কত ধরন আছে। ধানসহ বিভিন্ন সবজির বীজের সংকট, চিকিৎসার সংকট, খাদ্যের সংকট, বাড়ির সংকট, অনেক দিন বন্ধ থাকা স্কুলের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সংকট, কাপড়ের সংকট। এক কথায় বলা যায়, খাদ্য-চিকিৎসা-বাসস্থান-শিক্ষা-যোগাযোগ—সবকিছুরই এখন ভয়াবহ সংকট। একেক রকম সংকটে পাশে দাঁড়ানো একেক রকম ত্রাণ। দুধকুমর নদীর পূর্ব প্রান্তে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ-সংযোগ চালু হয়নি। এসব সংকটের পাশে আমাদের ত্রাণ অপ্রতুল। যার সামর্থ্য কম তিনি হয়তো এক শ টাকা দিচ্ছেন। যাঁর সামর্থ্য বেশি তিনি তো এক শ বাড়ি মেরামতের কাজের দায়িত্ব নিতে পারেন। আমাদের দেশে তো এ রকম বিত্তবানও আছেন, যার পক্ষে একটি ইউনিয়নের সবÿক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনেরও দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব।
লেখার শুরুতে যে কাকের কথা বলেছিলাম, সেই কাকটিকে অন্য সব কাক মিলে উদ্ধার করেছিল। আমরা সামর্থ্যবান মানুষেরা চাইলেও লাখ লাখ বানভাসি অসহায় মানুষদের উদ্ধার করতে পারব না, এ বিশ্বাসযোগ্য নয়। চলুন, আমরা কাকের কাছে এই শিক্ষা গ্রহণ করি, যতক্ষণ মানুষের অসহায়ত্ব দূর না হয়, ততক্ষণ তাদের পাশে থাকি।
জালবন্দী কাকের মুক্তি হয়েছে, কিন্তু জলবন্দী মানুষের?

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর