রাজনীতি

জামায়াত ভাঙছে, তারপর কী?

এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরগরম আলোচনা। দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে লন্ডন থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করা এবং দলের নাম ও নীতি পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনিচ্ছার কথা উল্লেখ করেছেন। রাজ্জাকের এই পদত্যাগ শুধু জামায়াতকে ধাক্কা দেওয়ার মধ্যে সীমিত থাকবে, না পুরো রাজনীতিতে ওলটপালট ঘটাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থান-পতন দুটোই নাটকীয় এবং কোনো না কোনো সময় তারা বড় দুই দলের সমর্থন পেয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও দুই দলের অনেক নেতা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দল নিষিদ্ধ করা হয়। সংবিধানে বলা হয়, ‘ধর্মের ভিত্তিতে কোনো দল করা যাবে না।’ কিন্তু পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন এবং জাতীয় সমঝোতার নামে ধর্মীয় রাজনীতির লাইসেন্স দেন। আর সেই সুযোগে জামায়াত কখনো বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে, কখনো আওয়ামী লীগের ছায়ায় নিজের অবস্থান সংহত করেছে। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের কয়েকজন নেতার বিচার করেছে। আবার নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি দলটি বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাতে জামায়াতকে সঙ্গী করতে দ্বিধা করেনি।

গত মঙ্গলবার প্রথম আলোয় ‘বিএনপির সঙ্গে আর থাকছে না জামায়াত’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দলটি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা রকম জল্পনা শুরু হয়। প্রশ্ন উঠেছে, জামায়াত কি সত্যি সত্যি বিএনপিকে ছাড়বে? কিংবা বিএনপি কি জামায়াতকে বাদ দিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করবে? বিএনপি-জামায়াত আলাদা হলে আওয়ামী লীগর অবস্থানই বা কী হবে?

বিএনপি ছাড়ার বিষয়ে জামায়াত যেসব যুক্তি দেখিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো সরকারের ‘দমনপীড়ন’। বিএনপির সঙ্গে থাকার কারণে যদি জামায়াতকে বাড়তি দমনপীড়নের শিকার হতে হয়, তাহলে ধরে নিতে হয় সরকারের প্রধান ‘শত্রু’ জামায়াত নয়, বিএনপি। বিএনপির নেতারা মনে করেন, তাঁরা জামায়াতকে ছাড়লে আওয়ামী লীগ কাছে টেনে নেবে। এর আগে সে রকম ঘটনাই ঘটেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা কিছুদিন আগেও বলতেন, বিএনপি ও জামায়াত-হেফাজত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই নাকি ঢাকা শহরে তাণ্ডব ঘটিয়েছিল? হেফাজত নিজেকে অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও রাজনৈতিক কারণেই এর প্রতিষ্ঠা। তারা আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি ও নারী উন্নয়ন নীতি বাতিল চেয়েছে। সেই হেফাজতের সঙ্গে বর্তমানে বিএনপির কোনো সম্পর্কের কথা শোনা যায় না, বরং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ‘সখ্য’ গড়ে উঠেছে।

নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী এবার স্বনামে নির্বাচন করতে পারেনি। জামায়াতের ২২ জন প্রার্থী বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন এবং কোনো আসন পায়নি। উল্লেখ্য, ভোটের হিসাবে, জামায়াত এখনো দেশের চতুর্থ বৃহত্তম দল। দলটি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০টি, ১৯৯১ সালে ১৮টি, ১৯৯৬ সালে ৩টি, ২০০১ সালে ১৭টি এবং ২০০৮ সালে ২টি আসন পায়।

এরশাদকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি ১৯৮৬ সালে নির্বাচন করতে রাজি না হলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত তাতে অংশ নিয়েছিল। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে (১৯৯১-৯৬) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে জামায়াতের সমর্থন চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। আবার ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে গড়ে ওঠে, তাতেও সংসদের ভেতরে ও বাইরে জামায়াত সক্রিয় ছিল।

সুতরাং, রাজনীতিতে সহজাত বা স্থায়ী মিত্র বা শত্রু বলে কিছু নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এখন যাঁরা বিএনপির মিত্র, তাঁদের বেশির ভাগই একসময় আওয়ামী লীগ করতেন। নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠাট্টাচ্ছলে সে কথা বলেছেনও। আবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও বিএনপির সরকারের প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানরা এখন আওয়ামী লীগের নতুন সুহৃদ।

এ অবস্থায় ২০-দলীয় জোট থেকে জামায়াতে ইসলামী বেরিয়ে যাওয়া বা বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার খবরটি অস্বাভাবিক হলেও অসম্ভব নয়।

আমাদের রাজনীতি বরাবর অসম্ভবের পথেই হাঁটতে অভ্যস্ত। জামায়াতের বিএনপি ছাড়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না বিএনপি জামায়াতকে বা জামায়াত বিএনপিকে ছাড়তে পারবে। এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটি হবে কৌশলগত।’

দেশের রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের দুর্ভিক্ষ চলছে। সবখানে কৌশল-অপকৌশলের খেলা এবং সেই খেলায় বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অধিক পারঙ্গম বলেই প্রমাণিত। আওয়ামী লীগ তিন-তিনবার বিএনপিকে একঘরে করেছে। বিএনপি আওয়ামী লীগকে একবারও একঘরে করতে পারেনি। ক্ষমতার রাজনীতির এমনই গুণ যে পরীক্ষিত সেক্যুলার দল মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করে, আবার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরাও ধর্মপন্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধতে দ্বিধা করে না।

আরেকটি উদাহরণ দিই। আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে চার মূল নীতি পুনর্বহাল করেছে বলে দাবি করে। একই সঙ্গে তারা এরশাদের রাষ্ট্রধর্মও রেখে দিয়েছে। দুটি একসঙ্গে যায় না। ভারতে মোদির নাগরিকত্ব বিল নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। বিলটি ভারতের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক—এই যুক্তিতে বিরোধীরা বাতিল করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে কোনো দলই আন্তরিকভাবে চায়নি রাষ্ট্রধর্ম উঠে যাক।

নীতি ও আদর্শের দিক থেকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে অনেক মিল আছে। বিএনপির ১৯ দফার সঙ্গে জাতীয় পার্টির ১৮ দফার তেমন ফারাক নেই। দুটো দলই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কথা বলে, যা আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতির বিপরীত। দুটো দলেরই জন্ম হয়েছে ক্ষমতার গর্ভে। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে আজ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে। দুজনে দুজনার।

অতীতে মরহুম মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর বক্তৃতা–বিবৃতি যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, তাঁর মতো আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিক বাংলাদেশে কমই আছে। তিনি একসময় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ সেই ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট এখন আর বিএনপির সঙ্গে নেই। খেলাফত মজলিসের একাংশও বিএনপির সঙ্গে থাকলেও অপরাংশ এরশাদের জোটে যোগ দিয়েছিল। 

২০১৩ সালে হেফাজত ঢাকা শহরে কী ধরনের তাণ্ডব ঘটিয়েছিল, তা সবার জানা। এখন তারা আন্দোলনে নেই। আন্দোলন ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অধিকাংশ দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছে। হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শোকরিয়া জানিয়েছেন। তার আগে লেখক–বুদ্ধিজীবীদের আপত্তি উপেক্ষা করে হেফাজতের দাবি মেনে সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকেও কথিত ‘অনৈসলামিক’ রচনাগুলো বাতিল করে দেয়।

অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখন জামায়াত বিএনপিকে ছাড়তে পারে। কিন্তু তাতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা জামায়াতের রাজনীতির বিরোধিতা করি শুধু একাত্তরের ভূমিকার কারণে নয়। একাত্তরের জন্য যদি তারা আইনজীবী রাজ্জাকের দাবি মেনে ক্ষমাও চায়, তাহলেও জামায়াতের রাজনীতি সমর্থন করা যায় না। কেননা যে রাজনৈতিক দর্শন জামায়াতকে এই পথে নিয়ে এসেছে, সেই দর্শন তো থেকেই গেছে। একই কথা প্রযোজ্য হেফাজতের বেলায়ও। তাদের ১৩ দফা মানলে আর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থাকে না। গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেফাজতের দর্শন জামায়াতের চেয়েও পশ্চাৎপদ। কয়েক দিন আগেও হেফাজতের আমির বলেছেন, নারী ও পুরুষ একসঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে না। নারী রোগীরা চিকিৎসার জন্য পুরুষ ডাক্তার দেখাতে পারবেন না।

অতএব গণতন্ত্র চাইলে জামায়াত ও হেফাজত দুটোকেই পরিত্যাগ করতে হবে। দলের ‘নাম পরিবর্তন’ কিংবা ‘অরাজনৈতিক’ ধুয়া তুলে জাতিকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com

আরও পড়ুন: