স্বাধীনতা সহজে প্রাপ্য নয়। বীরের রক্তস্রোতোধারা, মাতার দুঃখ, কন্যার অশ্রু ও অসংখ্য আত্মত্যাগের মাধ্যমেই সর্বত্র স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং অর্জিত স্বাধীনতাও এর ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে স্বাধীনতা রক্ষা করা, তাকে অর্থবহ করা এবং তাকে আরও গৌরবদীপ্ত করে সব নাগরিকের হৃদয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে শত শত গুণ কঠিন কাজ। স্বাধীনতা যদি নিছক পতাকা বদল, মানচিত্র বদল, ক্ষমতার হাতবদল হতো, তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের পর তাকে রক্ষা করাটা তেমন কঠিন কাজ হতো না। স্বাধীনতা বলতে আমরা তখন বোঝাতাম ‘রূপান্তর’ (ফরমাল চেঞ্জ), মর্মের পরিবর্তন (চেঞ্জ অব এসেন্স) নয়। কিন্তু আমাদের প্রিয় স্বদেশ যে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তা শুধু ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের বাহ্যিক রূপ পরিবর্তনের জন্য নয়। সেটা সত্য হলে সেদিন এত রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন হতো না। আমরা মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক থেকেই একটা আপসরফা করে চলতে পারতাম। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল মৌলিক অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য।
কিন্তু এই জন্মকালীন প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে? এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ টিকে আছে। হেনরি কিসিঞ্জাররা যেমন বলেছিলেন যে ‘বাংলাদেশ একটি তলাহীন ঝুড়ি’, তেমনটি ইতিহাসে সত্য হয়নি। কিন্তু এ কথাও সত্য যে আমরা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ কায়েম করতে পারিনি। শ্রমিক-কৃষকের মুখে হাসি ফুটে ওঠেনি। আজও ধর্মীয় ভন্ডামি, কূপমণ্ডূকতা এবং কখনো কখনো উগ্র ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে অবলীলাক্রমে। গণতন্ত্র আজ সন্ত্রাসের জাঁতাকলে এবং অর্থের দাপটে বড়ই কাতর। তাই স্বীকার করতেই হবে যে অর্জিত স্বাধীনতাকে এখনো আমরা সংহত করতে পারিনি।
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশে আজ একধরনের পুঁজিবাদী বিকাশ হচ্ছে। এ বিকাশের একই সঙ্গে দুটি রূপ দেখা যায়। একদিকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে হয়তো অচিরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাকশিল্পের অধিকারী হতে চলেছে, অন্যদিকে সেই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পেই মজুরি হচ্ছে বিশ্বের নিম্নতম। আলোর পাশেই অন্ধকার—পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের নিয়মই তাই।
‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে’ পুঁজিবাদী বিকাশের ঐতিহাসিক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো মার্ক্স যে ভাষায় প্রায় ১৬০ বছর আগে বর্ণনা করে গিয়েছিলেন, আজও বাংলাদেশে তা মোটা দাগে সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে—মার্ক্স লিখেছিলেন:
১. ‘নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়।’
তেমনটিই কি বাংলাদেশে আজ হচ্ছে না?
মার্ক্স ভেবেছিলেন পুঁজির এই আন্তর্জাতিক চরিত্র মনোজগতেও আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটাবে। মার্ক্স ওই একই পুস্তিকায় লিখেছিলেন:
২. ‘আগেকার স্থানীয় ও জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও স্বপর্যাপ্তির বদলে পাচ্ছি সর্বত্রই আদান-প্রদান, বিশ্বজোড়া পরস্পরনির্ভরতা। বৈষয়িক উৎপাদনে যেমন, তেমনই মনীষার ক্ষেত্রেও।’
বাংলাদেশে কি সে রকম হচ্ছে? এখানে তো চিন্তার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদীরাই বহাল তবিয়তে বিকশিত হচ্ছে! কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের মধ্যে দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি দেওবন্দী মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজতি ধারা। এটি প্রাচীনপন্থী এবং বিলীয়মান। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা আরেক ধরনের মৌলবাদেরও সাক্ষাৎ পাই যাকে আমি নাম দিতে চাই ‘আধুনিক পুঁজিবাদী মৌলবাদ’।
এটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের দল ‘জামায়াতে ইসলাম’। এই দলটি মৌলবাদী কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত ও কৌশলী একটি দল। এই দলের সঙ্গে পুঁজিবাদের কোনো শত্রুতা নেই। তাদের অনেক নেতাই পুঁজিপতি। আমেরিকানরা এই দলকে দেশে দেশে ব্যবহার করেছে প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে বহুবার। এ জন্যই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বাংলাদেশের জামায়াতকে মডারেট ইসলামিক পার্টির সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। এরা মূলত বিএনপির ধর্মভিত্তিক ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদকে পছন্দ করলেও সুবিধা দেখলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকেও নিজেদের কাজে লাগায়। তাদের ‘ওয়েবসাইট’ পরিদর্শন করলে আপনি দেখবেন সেখানে একটি সহযোগী সদস্যপদের ফরম আছে এবং সেটি অমুসলমানদের জন্যও উন্মুক্ত বলে দাবি করা হয়েছে। সেখানে যদিও প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করা হয়েছে, কিন্তু পরে দরখাস্তের ভেতরে তাকে যেসব শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে, তাতে কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে ‘ইসলাম’ ধর্মের কথাই নেই! আমি ফরমটি উদ্ধৃত করছি:
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
সহযোগী সদস্য ফরম
‘আমি...বিশ্বাস করি যে, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে শাসন ক্ষমতা ধার্মিক, চরিত্রবান ও নিঃস্বার্থ লোকদের হাতে থাকা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে এ ধরনের সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন কায়েমের চেষ্টা করিতেছে বলিয়া এ সংগঠনকে আমি আন্তরিকভাবে সমর্থন করি।
রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহিত সহযোগিতা করিব।
আমার জীবনকে নৈতিক দিক দিয়া উত্তম করিবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করিব এ জন্যই আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সদস্য হইলাম।’ (সূত্র: জামায়াতের ওয়েবসাইট)
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে দলটি সুকৌশলে প্রথমে নিরীহ একটি বক্তব্য দিয়ে সহযোগী সদস্য সংগ্রহ করে ধাপে ধাপে মগজ ধোলাই করে অবশেষে রগ কাটা জঙ্গি ক্যাডার তৈরি করে থাকে। মশিউল আলম লিখিত গ্রন্থ উইকিলিকসে বাংলাদেশ থেকে জানা যায় যে এই দলের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে গিয়ে আগেই ‘মিনতি’ জানিয়ে এসেছেন যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র খর্ব করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগ থাকবে না এবং নাইন-ইলেভেনের মতো জঙ্গি তৎপরতা তখন বৃদ্ধি পেতে পারে, যেটা আমেরিকার জন্যও ক্ষতিকর হবে, আর সে জন্যই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উচিত হবে আওয়ামী লীগকে বোঝানো, যাতে জামায়াতকে বেআইনি করা না হয়।
কিন্তু জামায়াত কি গণতান্ত্রিক দল? মার্কিনরা কি নাৎসি দলকে গণতান্ত্রিক দল বলেন? মনে রাখা উচিত জামায়াত এমন একটি দল, যেখানে তৈরি হয়েছিল একাত্তরের খুনিরা। যে দল এখনো একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে কোনো অন্যায় বলে মনে করে না এবং জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতাও আমাদের অজানা নয়। জামায়াতের শাখা-প্রশাখাও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। তাই যখন বাংলাদেশে জামায়াতের নেতা নিজামীর ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হলো তখন দেখা গেল, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামের আমির সিরাজুল হক বিবৃতি দিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। বলছেন:
‘…it was most unfortunate that the Pakistan government was maintaining a criminal silence over the convictions of patriotic Pakistanis who had sided with the Pak army although it could seek the end of these cases against the JI leaders present to the world at large the agreement signed by Sheikh Mujibur Rahman and Z. A. Bhutto that said that there would not be any war crimes trials.’ (সূত্র: পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির ওয়েবসাইট)
উপরিউক্ত বিবৃতিতে একটি অসত্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর সঙ্গে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, বাংলাদেশের দালালদের ব্যাপারে নয়। আরেকটি প্রচলিত ভুল তথ্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধু দালালদের মাফ করে দিয়েছিলেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যেসব দালাল যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই বন্দী ছিলেন এবং কারও কারও ক্ষেত্রে বিচারও শুরু হয়েছিল। দুর্ভাগ্য হচ্ছে জেনারেল জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও এই দালালদের পুনর্বাসন শুরু করেন। আর মুক্ত হওয়ার পর এঁরা দক্ষতার সঙ্গে সংগঠন এবং নিজস্ব পুঁজির বিকাশ ঘটিয়েছেন।
আজ তাই নিছক পুঁজিবাদী বিকাশের অভিঘাতে বাংলাদেশ থেকে জামায়াতের অভিশাপ দূর হবে না। বরং মৌলবাদী ধর্মীয় চিন্তা যখন পুঁজি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে সামনে এগোয়, তখন তাকে কিছুতেই খাটো করে নিছক সামন্তবাদের অবশেষ হিসেবে দেখলে চলবে না। বিচার ও শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও জামায়াতকে পরাজিত করতে হবে।
এ কথা সত্য যে বর্তমান পুঁজিবাদের অজস্র সীমাবদ্ধতা আছে, আছে ব্যাংকের দলীয়করণ ও দুর্নীতি, আছে অর্থ বিদেশে পাচারের সমস্যা, আছে বিদ্যুৎ-বন্দর-গ্যাস-সংকট, আছে বৈষম্য ও সুশাসনের সমস্যা, আর এগুলো ‘জামায়াতে ইসলামী’ও বোঝে। তাই তার স্লোগান হচ্ছে ‘সৎ লোকের শাসনে কল্যাণ অর্থনীতি’ চাই। লক্ষ করুন বর্তমান শাসকদলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিটি জামায়াত গ্রহণ করেছে, শুধু তার আগে জুড়ে দিয়েছে ‘সৎ লোকের শাসন’। এটাই তার বর্তমান কৌশল।
আমার মনে হয় বর্তমান শাসকদলে যদি অসৎ লোকদের প্রভাব বাড়তে থাকে এবং কল্যাণমূলক (প্রধানত অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান) প্রকল্পগুলো যদি ব্যর্থ হয় তাহলে এ দেশে ‘অসহায় দরিদ্র’ ও ‘লুটেরা ধনীরা’ আরও বাড়বে। জামায়াতও ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এই ভয়ংকর পরিণতি রোধ করতে হলে এখন থেকেই প্রগতিশীলদের এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে স্বাধীনতা সংহত করার লক্ষ্যে ইতিবাচক সাফল্যের পাল্টা দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে হবে। লুটেরাদের দমন ও ইহলোকেই দরিদ্রদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।