জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা শুনে শুনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছিলাম। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েও পাকা ইটের ছায়াময় একটি নন্দিত ভবন চোখে পড়ে—যা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে পরিচিত। বেসরকারি উদ্যোগে গরিবের এমন সহজ স্বাস্থ্যসেবা এ দেশে আর কে করছেন? গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ এ দেশের হাজার হাজার সন্তানকে মানবসম্পদে পরিণত করছে। এত কম পয়সার মানসম্মত এত শিক্ষাসেবা কে দিচ্ছেন এ দেশে?
লিমন নামের বরিশালের যে কিশোরকে বিনা অপরাধে সরকারের একটি বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে পঙ্গু করে দেন, ছেলেটির এক পা কেটে ফেলতে হয়, যাকে নিয়ে দীর্ঘদিন জাতীয় পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, তার পা-হারা ছবি দেশবাসীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে, যাকে নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব হয়েছিল, সেই ছেলেটিও তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে এখন লেখাপড়া করেছে সাভার গণশিক্ষা কেন্দ্রে। জানতাম না যদি না কয়েক দিন আগে এই ছেলেটিকে হাতভাঙা অবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাতরাতে দেখতাম। তার হাতটি পিটিয়ে ভেঙে দিয়েছেন এক শিল্পপতির পেটোয়া বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা অতর্কিতে হামলা করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ভাঙচুর চালান বিভিন্ন স্থাপনায়। বাদ যায়নি মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ এবং আন্তর্জাতিক সেমিনার ভবনও—যেখানে চলতি মাসে ৬০০ বিদেশি বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হওয়ার কথা।
লিমনের কথা আরেকটু বলি। এক পা-হারা ছেলেটির একটি হাত ভাঙা যেত না, যদি সে হামলাকারীদের রুখে দিতে না চাইত। যখন মেয়েদের নার্সিং কলেজে হামলা হয়েছে, আক্রান্ত, আহত, ভীত ছাত্রীরা যখন ভয়ে আর্তনাদ করছে, তখন এক-পা ছেলেটি ক্রাচে ভর করে লাফাতে লাফাতে গিয়ে হামলাকারীর সামনে দাঁড়িয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলেছে, এ কী করছেন আপনারা? আপনাদের কি মেয়ে নেই, বোন নেই? কেন ছাত্রীদের ওপর আঘাত? আর এতেই পায়ে পঙ্গু ছেলেটির একটি হাতও ভেঙে দিয়ে গেলেন তাঁরা। শিল্পপতির লোকজন—যে শিল্পপতিই জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনেছেন, মাছ চুরি, শাক চুরি, ফল চুরি—সবই চুরি করেন নাকি জাফরুল্লাহ!
ওই শিল্পপতি যে মামলা করেছেন, তা নিয়ে পুলিশ অতীব তৎপর। কিন্তু জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের মারধরসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অবকাঠামো ভাঙা হলো, তা নিয়ে জাফরুল্লাহ মামলা করতে গেলে পুলিশ সে মামলা নেয়নি। ফিরে যেতে হয় আলেক্সান্ডারের উক্তিতে, ‘সেলুকাস! এ বড় বিচিত্র দেশ!’
১৯৭১-এ জাফরুল্লাহ চৌধুরী লন্ডনে এফআরসিএস করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরীক্ষা ফেলে তিনি ভারতে চলে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তখন মারাত্মক চিকিৎসা-সংকট। আগরতলায় বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে এসে তিনি কাজ শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরম মমতায় তিনি চিকিৎসা দেন। শরীরের মধ্যে গেঁথে থাকা বুলেট তিনি অপসারণ করেছেন। প্রাণ বাঁচিয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধার। মনে রাখতে হবে সালটি ১৯৭১। ভারত তখন আজকের মতো নয়। তারও অভাব ছিল। সে দেশের ডাক্তারদের অকস্মাৎ বাংলাদেশ থেকে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। আর ফেরার সময় স্বাধীন স্বদেশেও খালি হাতে আসেননি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আগরতলার সেই বাঁশের হাসপাতালের মধ্যে যে মেডিকেল সরঞ্জামগুলো ছিল তা দেশে নিয়ে আসতে, এমনকি ট্রাকে করে সে ভাঙা টেবিল-চেয়ারগুলো আনতেও তিনি বিব্রতবোধ করেননি। এরপর দেশে ফিরে এক বন্ধুর বাবার দেওয়া বিঘা তিনেক জায়গার ওপর তিনি হাসপাতাল গড়ে তোলেন সাভারে। বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি এসেছিলেন এই হাসপাতালের জন্য সহযোগিতা নিতে। বঙ্গবন্ধু এই বঙ্গদরদিকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি।
তো জমি দখলের অভিযোগে আজ গরিব জনগণের প্রতিষ্ঠানটি এত বছর পর ভাঙচুর করা হলো। আমি বলছি না যে বাদী শিল্পপতির কোনো জমি গণস্বাস্থ্যের দখলে নেই। থাকলে তিনি আইনি লড়াইয়ে যাবেন, কিন্তু পেটোয়া বাহিনী দিয়ে কেন হামলার ঘটনা ঘটালেন?
দেশব্যাপী হাজার হাজার একর জমি আছে গণস্বাস্থ্যের। কিন্তু ব্যক্তি জাফরুল্লাহর কিছু নেই। যে ঢাকা শহরে জাফরুল্লাহ থাকেন, সেখানে একটি বাড়িও নেই। এত ত্যাগের প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। তাঁর খ্যাতি দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। এবার মাছ চুরির অপবাদ দিয়ে সেই খ্যাতিকে ম্লান করে দেওয়ার চেষ্টা!
জাফরুল্লাহ স্বনির্মিত মানুষ। বাবা-দাদার নাম নিয়ে তাঁকে পথ চলতে হয়নি কখনো। এ দেশে অবশ্য অনেক ধনকুবের ভূমি ব্যবসায়ীও আছেন, যাঁরা শত শত বিঘা সরকারি-বেসরকারি জমি জবরদখল করে সব সরকারের আমলে পার পেয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন।
আর যে মানুষটি গণস্বাস্থ্য থেকে কোনো লাভ নেন না, একটি ট্রাস্ট করে দিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের নামে, এর সব সম্পদের মালিক এই ট্রাস্ট। গরিব কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের জন্য যিনি এ ট্রাস্টের অধীনে গড়ে তুলেছেন অত্যাধুনিক ডায়ালাইসিস কেন্দ্র, ব্যক্তিজীবনে সম্পদহীন এই কর্মবীরকে হেনস্তা করা হচ্ছে আজ সরকারি ছত্রচ্ছায়ায়। সরকারের উচিত রাজনৈতিক ভিন্নমতের নিরিখে না দেখে জাফরুল্লাহর সারা জীবনের ত্যাগে গড়ে ওঠা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশে দাঁড়ানো এবং এই প্রতিষ্ঠানের জমিতে যাঁদের মালিকানার দাবি নিয়ে আজ ভাঙচুর চালানো হচ্ছে এর স্থাপনায়, সে দাবিগুলোও প্রচলিত আইনে শান্তিপূর্ণভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা।
আমি যে এত কথা বললাম জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে, তাঁকে এযাবৎ আমি কাছ থেকে দেখিনি। দেখেছি টেলিভিশনে। পাকা গোঁফ, দৃঢ়চেতা, আত্মবিশ্বাসী এক আত্মহারা অনন্য মানুষ। দূর থেকে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি এতকাল। এখন মনে হচ্ছে যেভাবে একটি মহল তাঁর পিছে উঠেপড়ে লাগছে, তাতে বয়স্ক এই মানুষটির জীবনপ্রদীপ যেকোনো মুহূর্তে নিভে যেতে পারে। তাই ঠিক করেছি, আমার সেই বন্ধুটিকে নিয়ে আমি এই ‘মাছচোর’কে সাক্ষাতে গিয়ে একবার সালাম করে আসব। আমার সেই বন্ধুটি একজন মুক্তিযোদ্ধা, বীর প্রতীক, ডাক্তার ও সাবেক প্রফেসর। যিনি জাফরুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে কাজও করেছেন এবং যাঁর কাছ থেকে একত্রে প্রাতভ্র৴মণকালে জাফরুল্লাহ সম্পর্কে আমি এত কথা জেনেছি। জীবনে মাতা-পিতার বাইরে পায়ে হাত দিয়ে কাউকে সালাম করা হয়নি। এই মহান মাছচোরকে আমার বৃদ্ধ বয়সে এসে সেইরূপ একটি সালাম জানাব ভাবছি—পায়ে হাত দিয়ে।
ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম সাবেক সচিব