মতামত

জাফরুল্লাহকে হুমকি ও বিএনপির জনবিচ্ছিন্নতার কারণ

গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিএনপিকে নিয়ে সবাই উঠেপড়ে লেগেছে কেন? ছাত্রদলের নেতারা গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে অপর প্রশ্নটি করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে জাফরুল্লাহ মন্তব্য করায় ওই নেতারা জানতে চেয়েছেন, জাফরুল্লাহ বিএনপির কে? কেন তিনি তাঁদের নেতার সমালোচনা করছেন? এসব প্রশ্নের আগে মির্জা ফখরুল এক আলোচনায় স্বীকার করছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ছাত্রসমাজকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না।

উল্লিখিত দুটি প্রশ্ন ও মির্জা ফখরুলের স্বীকারোক্তি পরস্পর-সম্পর্কিত। বিএনপি শুধু ছাত্রসমাজ কেন, জনমানুষকে গণ-আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। কেন পারছে না, এর উত্তর প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে।

সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব নিজেই বলেছেন, দেশ গভীর সংকটের মধ্যে আছে। মানুষের অধিকার নেই। গুম-খুন হচ্ছে নিরীহ মানুষ। প্রশ্ন হচ্ছে এ সংকট থেকে উত্তরণে নেতৃত্ব দেবে কে? জনসাধারণই যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ধরনের পরিবর্তনে জনসাধারণকে দিকনির্দেশনা দিতে হয়। নাগরিকদের মনে সাহস সঞ্চার করে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ। এ কারণে সবার বিএনপিকে নিয়ে এত মাথাব্যথা। কারণ, জনসাধারণ দেখতে চায় যেকোনো গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো প্রস্তুতি ও যোগ্যতা বিএনপির আছে কি না। জনসাধারণের এই আগ্রহকে যদি বিএনপি মাথাব্যথা হিসেবে চিহ্নিত করে, তবে বুঝতে হবে বিএনপি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। কোনটি মাথাব্যথা আর কোনটি জন-আকাঙ্ক্ষা, তা বিএনপি অনুধাবন করতে পারছে না। নাগরিকের ইচ্ছাকে ধারণ করতে পারছে না বলেই বারবার সবাই বিএনপিকে নিয়ে প্রশ্ন করে। কারণ, অনেকেই চায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি নেতৃত্ব দিক। কিন্তু বিএনপির মধ্যে সে ধরনের কোনো প্রস্তুতির আভাস নেই। তাই উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ প্রশ্ন করে, জানতে চায়, কেন বিএনপি পারছে না?

এক ভয়ংকর সংকীর্ণ মানসিকতা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘিরে ধরেছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে, তা বিএনপিকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পরও তিনি দেশের পুনর্গঠনের সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্য খাতে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। অসম্ভব জনবান্ধব এক ওষুধনীতি প্রণয়নে তিনি সরকারকে সহায়তা করেছেন। সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। তিনি রাজনীতির মানুষ নন। তিনি রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝে বক্তব্য দিতে পারেন না। যা মনে এসেছে, তা-ই বলে দিয়েছেন।

তিনি তারেক রহমানকে দুই বছর রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে মেয়ে জাইমা রহমানকে রাজনীতিতে আনার প্রস্তাব করেছেন। তাঁর এ বক্তব্যের ভিন্ন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। এ ধরনের কথা তিনি এর আগেও বলেছেন। গত নির্বাচনে ডা. জাফরুল্লাহসহ অনেকের পরামর্শে বিএনপি বা তারেক রহমান ঐক্যফ্রন্ট গঠনে করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি বিএনপির জন্য। তাই তারেক রহমানের নেতৃত্ব সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করার জন্য তাঁদের পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। এ কারণেই ডা. জাফরুল্লাহের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই একমত নন। আর রাজনীতির জন্য কাউকে পড়াশোনার নসিহত করা ঔপনিবেশিক মানসিকতার লক্ষণ। রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে হয় না। নেতৃত্বের গুণাবলি নানাভাবে রাজনীতিবিদদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এটি কিছুটা প্রাকৃতিক। নেতা তৈরি করা সম্ভব নয়। নেতা তৈরি হয়।

বিএনপি নিজেদের গণতান্ত্রিক দল মনে করলে যেকোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। কথার উত্তরে কথা বলতে হবে। যুক্তির বদলে যুক্তি আসবে। হুমকি নয়।

ডা. জাফরুল্লাহ যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, তা বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর মনঃপূত হয়নি। তিনি যদি ভুলও বলে থাকেন, তা রাজনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল; প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে নয়। এ ধরনের হুমকি জনমনে বিএনপি সম্পর্কে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। ডা. জাফরুল্লাহকে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, এরপর তিনি একই ধরনের বক্তব্য দিলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির দায়দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করবে না। এ হুমকি সমাজে বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা প্রদান করবে। দিনের আলোয় হুমকি প্রদান প্রতিপক্ষের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দেবে। নেতিবাচক প্রচারণার আগুনে নতুন করে ঘি ঢালবে। এসব প্রচারণার আড়ালে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও গুমের বিবরণ ঢাকা পড়বে।

বিএনপি নিজেদের গণতান্ত্রিক দল মনে করলে যেকোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। কথার উত্তরে কথা বলতে হবে। যুক্তির বদলে যুক্তি আসবে। হুমকি নয়। রাজনৈতিক নেতারা একটি দলের নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁরা সারা দেশের জনসাধারণের নেতা। তারেক রহমানের বাবা ও মা দুজনই দেশ শাসন করছেন এবং দুজনই প্রবলভাবে জনপ্রিয়। এ হিসাবে তারেক রহমানেরও নিজস্ব জনপ্রিয়তা আছে। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা দলের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করলেই জাতীয় নেতায় পরিণত হওয়া যায়। কিন্তু জাতীয় নেতা হওয়া সহজ নয়। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকার পরও নানা ধরনের সমালোচনা-আলোচনা থাকবে। অনেকেই গালমন্দ করবে। রাজনৈতিক নেতার কাজ হচ্ছে সব শুনে, বুঝে জনসাধারণের ক্ষোভকে প্রশমন করে তা ভালোবাসায় রূপান্তরিত করা। যখনই কোনো নেতা জনপ্রতিক্রিয়াকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারবেন না, তখনই তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। জনবিচ্ছিন্ন নেতার ডাকে জনসাধারণ কোনো সাড়া দেয় না। আর যাঁরা সমালোচনাকে গ্রহণ করে রাজনীতি করেন, তাঁরাই জাতীয় নেতায় পরিণত হন।

দমন-নির্যাতনের শিকার বিএনপির নেতা-কর্মীরা দাবি করেন তাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। কিন্তু নেতা-কর্মীদের মধ্যেই যে ফ্যাসিবাদ বিস্তার করছে, এটাও বিএনপিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিএনপির সমালোচনা করলেই ফ্যাসিবাদের দালাল, দোসর বলে মন্তব্য করা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর। এক ফ্যাসিবাদ থেকে আরেক ফ্যাসিবাদের খপ্পরে জনসাধারণ পড়তে চায় না। ভরা মজলিশে যখন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিককে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হয়, তখন সাধারণ নাগরিক বিএনপির আন্দোলনে আকৃষ্ট হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলে কিছু বিষয় আছে। এসব বিষয়ে বিএনপির সতর্কভাবে বিবেচনা করা উচিত। মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, সাধারণ ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। কেন ব্যর্থ হয়েছেন, এটার উত্তর তিনি সম্ভবত ডা. জাফরুল্লাহকে শিষ্টাচারবহির্ভূত প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়ার ঘটনা থেকে পেয়ে গিয়েছেন।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক