শ্রীলঙ্কার উত্তরে জাফনা। তামিলদের অঘোষিত রাজধানী। বাংলাদেশের পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের সঙ্গে জাফনার কিছুটা তুলনা চলে। সাগরের ধারে সবুজ এক জনপদ। তবে জাফনা ঘুরলে যে কারও অনুসন্ধানী চোখ ও হৃদয় অনায়াসে স্থলভাগেও শোক ও বেদনার গভীর আরেক সাগর খুঁজে পাবে।
গৃহযুদ্ধের আগে জাফনা ছিল দেশের দ্বিতীয় জনবহুল শহর। এখন জনসংখ্যায় ১২তম। কেবল এই তথ্যেই বোঝা যায় গৃহযুদ্ধ জাফনাকে কতটা রিক্ত করেছে।শ্রীলঙ্কায় ২৬ বছরের জাতিগত যুদ্ধ শেষ হলো ২০০৯ সালে। কিন্তু গত ১১ বছরেও জাফনায় শোকের গভীরতা কমেনি। নভেম্বর এলে সেটা বোঝা যায়। এ মাসের শেষ দিনগুলো জাফনা বিষণ্নতা ও বোবাক্ষোভে ভুগতে থাকে। এর মাঝে সবচেয়ে শোকাবহ ২৭ নভেম্বর।
তামিলরা দিনটিকে বলে ‘মাবিরের নার্ল’। তামিল ভাষায় মা মানে মহা। ‘নার্ল’ হলো দিন। বাংলায় ‘মাবিরের নার্ল’ মানে ‘মহাবীরদের দিন’। মাবিরের নার্ল উদ্যাপন শুরু হয় ২৭ নভেম্বরের কয়েক দিন আগে থেকে। চলে ২৭-এর পরেও দু-এক দিন। তবে ২৭ তারিখই শোক উৎসবের মূল দিন। আগের দিন ২৬ নভেম্বর পালিত হয় তামিল সশস্ত্রতার প্রয়াত প্রধান প্রভাকরণের জন্মদিন।
হারানো যোদ্ধাদের স্মরণে নিষেধাজ্ঞা
তামিলরা এখন বিশ্বের বড় এক প্রবাসী জনগোষ্ঠীও বটে। শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া প্রায় নয় লাখ তামিল আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অনেকেই এরা যুদ্ধাবস্থার কারণে দেশান্তরি। দেশ ছাড়লেও রাজনীতি সচেতন জনগোষ্ঠী তামিলরা। ফলে ‘মাবিরের নার্ল’ পালিত হয় বিশ্বজুড়ে। কিন্তু জাফনায় তার আবেদন অতি তীব্র।
গৃহযুদ্ধের দিনগুলোতে ২৭ নভেম্বরের আয়োজনে এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলম) শোক ও বীরত্বের প্রকাশ ঘটাত বিপুল মাত্রায়। এখন তারা পরাস্ত। প্রভাকরণসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মৃত। আবার বিপরীত দিকে ক্ষমতায় ফিরেছেন সেই সিংহলি ভ্রাতৃদ্বয় মাহিন্দা এবং গোট্টাবায় রাজাপক্ষে। এঁদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বেই এক দশক আগে তামিল টাইগারদের হারিয়ে গৃহযুদ্ধে জিতেছিল সরকার। ফলে এটা অস্বাভাবিক নয়, এবার সেই জুটির ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট এবং বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মিলে তামিলদের মাবিরের নার্ল পালনে বাধা দেবে। এত দিন এই নিষেধ হতো প্রশাসনিক। এবার নিষেধ নিশ্চিত করেছেন আদালতও। নভেম্বর আসতেই মান্নার, ভাবুনিয়া, কিলোনিচ্চিসহ উত্তরের জেলাগুলোর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট মাবিরের নার্ল বন্ধের হুকুম দিয়েছেন। আদালত বলছেন, কোভিডের কারণে এই বাধা। তবে আদালতের এই সহায়তা তামিলদের প্রতি আরও কঠোর হতে রাজাপক্ষেদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হয়েছে।
আমূল বদলে গেছে জাফনা
গৃহযুদ্ধে এলটিটিই হেরে যাওয়ার পর থেকে মাবিরের নার্ল পালিত হতো মূলত মোমবাতি জ্বালিয়ে। এখন সেটুকুও করতে দিতে চায় না সরকার। জাফনায় ২৭ নভেম্বর প্রকাশ্যে দল বেঁধে মোমবাতি জ্বালাতেও বাধা থাকবে।
প্রয়াত টাইগারদের স্মরণে অতীতে নভেম্বরের বড় অনুষ্ঠানটি হতো জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা, তামিল জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সে রকমই, কিংবা তার চেয়েও বেশি। এবার ২৬ ও ২৭ নভেম্বর জাফনা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এলটিটিই সক্রিয় থাকার দিনগুলোতে জাফনায় এ রকম নিষেধাজ্ঞার কথা কল্পনাও করা যেত না। তখন মাবিরের নার্লের মূল অনুষ্ঠানে প্রভাকরণ নতুন কী বলেন, সেটা শোনার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন কলম্বোর নীতিনির্ধারকেরা। সহযোদ্ধা শংকরের মৃত্যুর মুহূর্তটি স্মরণ করে সচরাচর ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টায় প্রভাকরণ জাফনা কিংবা আশপাশে কোথাও গেরিলাদের সামনে এ রকম ভাষণ দিতেন। রক্তাক্ত সেই দিনগুলো শ্রীলঙ্কাকে এখনো শিহরিত করে। তবে এক দশকে জাফনা আমূল বদলে গেছে। প্রায় কেউই রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে চায় না আজ। এলটিটিই নিয়ে তো নয়ই। সবার মনোযোগ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত নিজ নিজ অর্থনীতি সারাইয়ে। তবে হারানো স্বজনদের কথা মনে করিয়ে দিতে নভেম্বর ফিরে ফিরে আসে।
২৭ নভেম্বর: পেছন ফিরে দেখা
১৯৮৯-এ প্রথম ‘মাবিরের নার্ল’ পালন করে তামিলরা। তারও সাত বছর আগে ১৯৮২-এর ২৭ নভেম্বর মারা যান এলটিটিইর লেফটেন্যান্ট শংকর, সংগঠনের প্রথম শহীদ। তাঁর স্মরণে দিনটি বেছে নেওয়া হলেও পরে এলটিটিই সব মৃত যোদ্ধাকে ওই দিন একত্রে স্মরণের রেওয়াজ চালু করে। এর সঙ্গে প্রভাকরণের জন্মদিনের আয়োজনও যুক্ত করা হয়। এভাবে মাবিরের নার্ল প্রায় সাত দিনজুড়ে পালন শুরু হয়।
দাপটের দিনগুলোতে এলটিটিই জাফনার বিভিন্ন স্থানে তাদের ‘বীর’দের মৃতদেহ সৎকারে বিশাল এলাকা চিহ্নিত করে রেখেছিল। তামিলরা এসব জায়গাকে বলে ‘থুইলাম ইলম’ বা শেষ বিশ্রামের জায়গা। এখনো মানুষ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসব জায়গায় আসে। তবে এবার পুলিশ মাবিরের নার্ল পালিত হওয়ার পুরোনো জায়গাগুলোর সব পথ বন্ধ করে রেখেছে। ২১ নভেম্বর থেকে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট।
তবে তামিলদের কাছে ২৬ ও ২৭ নভেম্বরের আবেদন এমন যে নিরাপত্তা বাহিনী পুরো জাফনা স্তব্ধ করে রাখলেও অধিকাংশ বাড়িতে দরজা-জানালা বন্ধ করে হলেও প্রয়াত যোদ্ধাদের স্মরণ করা হবে। বাদ যাবে না প্রভাকরণকে স্মরণও। তুমুল বিতর্ক নিয়েই তামিল জাতীয়তাবাদের প্রধান চরিত্র হয়ে আছেন প্রভাকরণ। তাঁকে নিয়ে মিথ ও কিংবদন্তির ব্যাপকতা অনেক। অনেক তামিলের জন্য আজও বিশ্বাস করা কঠিন প্রভাকরণ নেই। সিংহলিদের বড় অংশের কাছেই তিনি সন্ত্রাসী। তাঁর গড়া সংগঠনটিও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বহু দেশে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই গণ্য বহুকাল। তবে তামিলদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা উধাও হয়েছে এমন বলা যায় না। সিংহলিরা তার কোনো সুরাহা করতে পারেনি।
তামিলরা মাবিরের নার্লের প্রতীক করেছে বাংলাদেশের অতি পরিচিত ফুল উলটচন্ডালকে। এটা জাফনায় বিশেষভাবে নভেম্বরে ফোটে। উলটচন্ডালগাছ বিষাক্ত হলেও লাল-হলুদে মেশানো এর ফুল বড় তীব্র এক সুন্দর! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে বলতেন অগ্নিশিখা। প্রশ্ন জাগে, কবিরা কী ভবিষ্যৎও দেখেন?
২৬ বছরের যুদ্ধে শ্রীলঙ্কায় প্রায় এক লাখ বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। দুপক্ষের যোদ্ধা মারা গেছে প্রায় ৫০ হাজার। এর মাঝে এলটিটিই হারিয়েছে প্রায় ২৭ হাজার যোদ্ধা। যুদ্ধের শেষ মাসেই কেবল দেশটির উত্তরে মারা যায় ৯ হাজার মানুষ। যে মৃতদের মধ্যে ছিলেন ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণও।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার এসব ঐতিহাসিক ক্ষত থেকে সামনে এগোতে চায়। তবে সেটা বিজয়ীর বেশে। তামিলদের ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষতিপূরণ এবং উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক সংস্কার রাজাপক্ষে ভ্রাতৃদ্বয়ের অগ্রাধিকারে নেই। জাতিগত দূরত্ব তাই থাকছেই নীরবে।
সাম্প্রতিক ভোটগুলোতে সিংহলি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নহীন বিজয় ঘটেছে। তামিলরা সামরিকভাবে তো বটেই, রাজনৈতিকভাবেও কোণঠাসা এখন। প্রেসিডেন্ট গোট্টাবায়া এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন। ইতিমধ্যে দেশকে পুরোনো সংসদীয় শাসন থেকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভিক্ষুসংঘগুলোর ধর্মীয় চাওয়া-পাওয়া পূরণ করায় রাজাপক্ষে পরিবারের সমর্থনের পরিসর বেড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পুরোপুরি এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে।
প্রেসিডেন্ট ছাড়াও মন্ত্রিসভায় একই পরিবারের চারজন আছেন। তাঁদের হাতে আছে আটটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। সরকারের সহযোগী হিসেবে আছেন বর্তমান ও সাবেক সিংহলি সেনা কর্মকর্তারা। আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাঁদের বসানো হয়েছে। এভাবে যুদ্ধহীন শ্রীলঙ্কাতে সরকার পরিচালনায় যুদ্ধকালীন একটা আবহ রাখা হয়েছে। সঙ্গে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের ধর্মতাত্ত্বিক ছাপও। এর মাঝে উত্তরে তামিলদের অবস্থা যেমন বোঝা যায় ‘মহাবীরের নার্ল’-এর নিষেধাজ্ঞা থেকে, তেমনি পূর্বাঞ্চলে মুসলমানরাও আছেন প্রচণ্ড চাপে। গত বছর কয়েকজন মুসলমান কর্তৃক চার্চে হামলার রহস্যময় ঘটনা থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন-হামলা অনেক বেড়েছে। করোনাকালে মহামারি ছড়ানোর জন্য তাঁদের অভিযুক্ত করা হচ্ছিল সামাজিকভাবে। যে কয়েকজন মুসলমান মহামারিতে মারা গেছেন, তাঁদের কবরস্থ করতেও বাধা দেওয়া হয়।
তামিল ও মুসলমানরা মিলে দেশটির জনসংখ্যার ২২ ভাগ। অতীতে এদের মাঝে পারস্পরিক মৈত্রীর চেয়েও বৈরিতা ছিল বেশি। এখন সিংহলি জাতীয়তাবাদের তীব্রতার মুখে নিজেদের তাঁরা বঞ্চনার একই পাটাতনে দেখতে পাচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই একটা খারাপ বার্তা। শোক প্রকাশের অধিকার বা ধর্মীয় রীতিতে কবরস্থ হতে না পারা এ অঞ্চলে জাতিবাদের নতুন তরঙ্গের কথা জানাচ্ছে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক