মতামত

জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী কতটা কী পারবেন

জাপানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা
ছবি: রয়টার্স

জাপানের স্থানীয় সময় গত সোমবার বিকেলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ বিশেষ জরুরি অধিবেশনে মিলিত হয়ে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার প্রক্রিয়ায় ভোট দেয়। তবে উভয় কক্ষে ক্ষমতাসীন জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকায় ভোটের প্রক্রিয়া সার্বিক অর্থেই ছিল আনুষ্ঠানিক। নিম্নকক্ষের ৪৫৮টি ভোটের মধ্যে প্রধান ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ফুমিও কিশিদা পেয়েছেন ৩১১ ভোট। অন্যদিকে উচ্চকক্ষে ২৪১টি আসনের মধ্যে কিশিদার পক্ষে ভোট পড়েছে ১৪১টি। ফলে অনেকটা বিনা বাধায় দেশের শততম প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হলেন জাপানের সাবেক এ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হয়ে প্রথম যে দায়িত্ব কিশিদা পালন করলেন তা হলো নতুন একটি মন্ত্রিসভা গঠন, যেমনটা আগে থেকেই প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিশিদার মন্ত্রিসভায় দলীয় নেতা নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন দেওয়া উপদলের সদস্যদের সংখ্যাই কেবল বেশি নয়, একই সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও সাবেক অর্থমন্ত্রী তারো আসোর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

কিশিদার নতুন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া দুজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেন নেতৃত্বের নির্বাচনে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সাবেক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তারো কোনো এবং কোনোর প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন ব্যক্ত করা বিদায়ী মন্ত্রিসভার পরিবেশমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি। ফলে দায়িত্ব পালনের সূচনালগ্নে নেওয়া কিশিদার এ পদক্ষেপ অনেকটা প্রকাশ্যে দেখিয়ে দিল যে দলের ভেতরে ভিন্নমতের জন্য জায়গা করে দিতে তিনি ও তাঁকে সমর্থন দেওয়া নেতৃত্ব নারাজ। তবে পর্যবেক্ষকেরা অবশ্য বলছেন, যতটা না কিশিদার নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে, এর চেয়ে বেশি দেখা গেল পর্দার আড়ালে থাকা নেতৃত্বের ক্ষমতার ভিত কতটা শক্ত, তার বাস্তব চিত্র। ফলে তাঁদের ধারণা, নতুন মন্ত্রিসভা পরোক্ষে হয়ে উঠেছে সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী এবং দলের বড় দুটি উপদলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে ধরে রাখা রাজনীতিক—শিনজো আবে ও তারো আসোর ছায়া মন্ত্রিসভা। দুই নেতার মধ্যে আবের পাল্লা তুলনামূলকভাবে ভারী হওয়ায় কিশিদার পক্ষে নিজের ইচ্ছার নীতিমালার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই দেখা দিচ্ছে।

বাইরে থেকে দৃষ্টিপাতে এ মন্ত্রিসভাকে নতুন মুখের সমন্বয় বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। মন্ত্রিসভার ২০ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্যের মধ্যে ১৩ জনই প্রথমবারের মতো মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। এর বাইরে দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রীর পদে থাকা তারো আসোর সরে দাঁড়ানোকেও নতুনত্বের আরেকটি প্রকাশ বলে ভুল হতে পারে। তবে একটু ভেতরে আলোকপাত করলে অবশ্য ভিন্ন এক ছবির দেখা পাওয়া সহজেই সম্ভব। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল ঘটানো হয়নি। আবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবের ছোট ভাই। এ ছাড়া নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে কিশিদা নিয়োগ দিয়েছেন একসময়ের অলিম্পিক–বিষয়ক মন্ত্রী শুনইচি সুজুকি, যিনি কিনা আবার বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আসোর শ্যালক। ফলে পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া দুই নেতা ক্ষমতার রাশ ঠিকই ধরে রাখবেন বলে অনেকের ধারণা, যা কিনা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন কিশিদার জন্য অসম্ভব করে তুলতে পারে।

কেবল তা–ই নয়, মন্ত্রিসভার গঠনও হচ্ছে আড়ালের দুই নেতার অনুসারীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। এর বাইরে নতুন মুখের কথা বলা হলেও বয়সের দিক থেকে তাঁদের অনেকেই তারুণ্যের পর্যায়ে কোনো অবস্থাতেই পড়েন না। এর আগে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর দায়িত্ব তাঁদের অনেকে পালন না করলেও পার্লামেন্টে ও উপদলীয় কোন্দলে তাঁদের অংশগ্রহণ নতুন নয়। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের গড় বয়স ৬১ দশমিক ৮ বছর, এটি নিয়েও কথা উঠেছে।

নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রেখে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে এটি যেকোনো অবস্থাতেই অনুকূল পরিবেশ নয়, কিশিদা সে বিষয়ে ভালোভাবে অবগত। ফলে মন্ত্রিসভা গঠনের পর দ্বিতীয় আশু করণীয় বলে কিশিদা যেটিকে মনে করছেন, তা হলো পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে দ্রুত একটি সাধারণ নির্বাচন দেওয়া। নিম্নকক্ষের মেয়াদ এমনিতেই আগামী মাসে উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে ধারণা করা হচ্ছিল, কিশিদা হয়তো নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় নির্বাচন দেবেন। তবে বিকেলে মন্ত্রিসভা গঠনের পরই সেদিন রাতে ডাকা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে কিশিদা ঘোষণা করেন যে আগামী সপ্তাহে নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে চলতি মাসের শেষ দিনে সাধারণ নির্বাচন দিচ্ছেন তিনি। তড়িঘড়ি নির্বাচন দেওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো, নতুন প্রশাসনের প্রতি স্বাভাবিক নিয়মে দেখা যাওয়া জনসমর্থন বজায় থাকা অবস্থার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে রাজি নন।

সাধারণ হিসাব–নিকাশ বলছে, নিম্নকক্ষে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা তেমন কঠিন হবে না নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তবে বর্তমানের ব্যাপক সংখ্যাধিক্য ধরে রাখতে তিনি কতটা সক্ষম হবেন, সেই প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়। দলীয় সভাপতি নির্বাচনে মাঠপর্যায়ের নেতা–কর্মীদের পছন্দের দিকটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে পর্দার আড়ালের নেতারা যেভাবে কিশিদাকে বেছে নিয়েছেন, ভোটের ফলাফলে তার প্রভাব কিছুটা হলেও পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সে রকম অবস্থা দেখা দিলে দলের প্রভাবশালী নেতারা হয়তো অন্য কাউকে নতুন নেতা হিসেবে বেছে নিতে পারেন। আর তা না হলে হাত-পায়ের বন্ধন কিছুটা শিথিল করে নিয়ে আংশিকভাবে হলেও নিজের নীতির বাস্তবায়ন কিশিদার পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে। হাওয়া কোন দিকে বয়, তা দেখার জন্য মাসের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে।

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক