আপনি যদি কখনো কোনো জাপানির সঙ্গে পরিচিত হতে যান, তাহলে কথোপকথনের প্রথমেই আসবে ‘জাতীয় পতাকা’র প্রসঙ্গ। জাপানিদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশকে চেনে বা জানে আমাদের পতাকার মাধ্যমে। এ দেশের বাচ্চাদের যখন স্কুলে দেশ পরিচিতি শেখানো হয়, তখন থেকেই তারা দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ সম্পর্কে, এর সংস্কৃতি ও মানুষ সম্পর্কে জানে। লাল বৃত্তের দুই দেশের পতাকার এই অদ্ভুত মিলের কারণে বাংলাদেশকে জাপানিদের অনেক কাছে টেনেছে। বন্ধুত্বের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জাপান এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আস্থা ও নির্ভরশীলতার বড় অংশীদার। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের যে উন্নয়নের বাতায়ন বিশ্বদরবারে প্রশংসিত হচ্ছে, তার নেপথ্যের বড় নায়ক পূর্ব এশিয়ার এ দেশ। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মেলবন্ধনে ১০ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ‘সুবর্ণজয়ন্তী’।
প্রায় আট বছর আগে উচ্চশিক্ষার জন্য যখন জাপানে এসেছিলাম, তখন দেশটি সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিল না। পড়াশোনার পাশাপাশি গত ছয় বছর দেশের শীর্ষ একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতা করার সুবাদে ধীরে ধীরে দেশটি সম্পর্কে যেমন জেনেছি, তেমনি বাংলাদেশ নিয়ে জাপানিদের উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসাও হৃদয়ে অনুভব করেছি। নিয়মতান্ত্রিক কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে বাংলাদেশ-জাপানের সম্পর্কোন্নয়নে দুই দেশের সরকারের যে আন্তরিকতা দেখতে পেয়েছি, তা সত্যি আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আছে কি না, আমার জানা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের যেকোনো দুর্যোগ ও বিপদের সময় বাংলাদেশের পাশে জাপানের দাঁড়ানোর যে চেষ্টা, তার শুরুটা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পরের মাসই বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন জাপানের শ্রমমন্ত্রী তাকাশি হায়াকাওয়া। ১৯৭২ সালের ১৪ মার্চ ওই সফরে বঙ্গবন্ধুকে জাপান সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানোর পরই তাঁর হাতে দেন জাপান সফরের আমন্ত্রণপত্র। বাংলাদেশ ভ্রমণে যাওয়ার আগে এই তাকাশি হায়াকাওয়া নিজেই জাপানের সংসদে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও পরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কৃত করেছে।
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময় থেকে উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে নিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে শতাধিক শিক্ষার্থী জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে আসছেন। নিঃস্বার্থভাবে এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে এসে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে যেমন পরিচিত হচ্ছেন, তেমনি এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, যার মাধ্যমে দুই দেশের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির আদান-প্রদান হচ্ছে।
জাপান সরকারের এ আমন্ত্রণের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের জাপান সফরে এসেই উত্তরের জনপদের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার চলাচলকে সহজ করতে ‘যমুনা সেতু’ করে দেওয়ার জন্য জাপান সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোকেই তানাকার কাছে অনুরোধ করেন। সেই জাপান সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য ৯ হাজার মিলিয়ন জাপানি মুদ্রার একটি তহবিল গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর ওই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের একটি বড় ভিত্তি স্থাপিত হয়।
পঁচাত্তরের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর স্মরণে জাপানের সংসদে শোক প্রস্তাবও করা হয়েছিল। এরপর দুই দেশের মধ্যে যখন কোনো সংকটের সময় এসেছে, তা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাপান এয়ারলাইনস বা জালের ফ্লাইট ৪৭২–এর ডিসি ৮ বিমানটি দেশটির উগ্রবাদী রেড আর্মি যখন ১৫১ যাত্রীসহ ছিনতাই করে ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে এসেছিল, তখন সেটি জাপানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মধ্যস্থতাকারী ছিল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার। সেই অবদান জাপানিরা আজও স্মরণ করে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সড়ক ও যোগাযোগ, সেতু, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আর্থসামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক অনুদান ও আনুষঙ্গিক সহায়তা করে যাচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। জাপান সরকারের এই সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশে ঠিক কী কী কাজ করছে, তার আলোচনা ইতিমধ্যে প্রথম আলোতে এক নিবন্ধে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি জানিয়েছেন, যার আলোকপাত এখানে আমি করছি না।
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময় থেকে উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে নিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে শতাধিক শিক্ষার্থী জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে আসছেন। নিঃস্বার্থভাবে এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে এসে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে যেমন পরিচিত হচ্ছেন, তেমনি এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, যার মাধ্যমে দুই দেশের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির আদান-প্রদান হচ্ছে।
এই যে কয়েক বছর আগে থেকে দক্ষ মানবসম্পদ ক্যাটাগরিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশিদের কর্মী হিসেবে জাপান সরকারের নিজস্ব অর্থ ও তত্ত্বাবধানে নিয়োগ দিচ্ছে, যা আমাদের প্রবাসী আয়ের সুবর্ণ সুযোগ বটে।
২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর বিশ্বের বড় বড় দেশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তখন বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বাংলাদেশকে জঙ্গি মোকাবিলায় কারিগরি সহায়তাও দিয়েছেন তাঁরা। ওই হামলায় সাত জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছিলেন।
প্রায় ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি জাপানে বসবাস করছে। এই প্রবাসীরা কখনোই নিজেদের জাপানিদের চেয়ে আলাদা ভাবতে পারেন না। কারণ, এই দেশের সুযোগ-সুবিধা একজন জাপানি যেভাবে পায়, ঠিক তেমনি বিদেশিরাও পায়। জাপান শুধু দিয়ে গেছে। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। কোভিড মহামারির কথা ধরা যাক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ টিকা নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড করলেও জাপান অভূতপূর্বভাবে টিকাসহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশকে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে ভুল করেছে, তা হলো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে পিছিয়ে থাকা। জাপানের মেইজি আমলের শিক্ষাব্যবস্থা যে কতটা শক্তিশালী ও অগ্রগামী, তা এখানে যাঁরা পড়াশোনা করতে এসেছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে, ভবিষ্যতে অন্তত শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে জাপানের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া। আমি যতটুকু জানি, জাপান এ বিষয়ে যথেষ্ট উদার। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি সত্যিই তা করতে পারি, তাহলে আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণায় শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সম্পর্কের এ অববাহিকা আরও বেশি মজবুত হোক, সৌহার্দ্যের হোক, বন্ধুত্বের বন্ধনে আটকা থাকুক বাংলাদেশ-জাপানের পথচলা।
ড. নাদিম মাহমুদ, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক