একেক সময় একেক চেহারা, একেক বর্ণ, একেক রূপ ধরে জাতীয়তাবাদ আমাদের সামনে আসে। কখনো জাতিসত্তা, কখনো নাগরিক সত্তা, কখনো ধর্মীয়, কখনো পার্থিব, কখনো ডান, কখনো বাম—এই রকম বহু চেহারা নিয়ে সে হাজির হয়।
এক শতাব্দী আগে থিয়োডর রুজভেল্টের নব্য জাতীয়তাবাদ ইনহেরিট্যান্স ট্যাক্স চালু, রাজনীতিতে করপোরেট অর্থ ঢালা নিষিদ্ধ, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও বেঁচে থাকার মতো মজুরি ব্যবস্থা চালুর ডাক দিয়েছিল। তাঁর সেই চিন্তাভাবনার প্রায় উল্টো দর্শন নিয়ে সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করা ন্যাশনাল কনজারভেটিভ কনফারেন্স একটি ‘নতুন আমেরিকান ও ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ’-এর রূপরেখা দিয়েছে। এই রূপরেখা সুষম বরাদ্দ করা, জাতীয় সীমানায় কড়া নজরদারি করা ও অ্যাংলো-আমেরিকান জাতীয় ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সাংবিধানিকতাবাদ, অভিন্ন আইন, ইংরেজি ভাষা এবং খ্রিষ্টধর্মগ্রন্থের অনুশাসন—এগুলো সমুন্নত রাখাই ‘নতুন আমেরিকান ও ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ’এর মূল প্রতিপাদ্য।
দুনিয়াতে এত পদের জাতীয়তাবাদের চল আছে যে এখন যে কাউকে থমকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে: জাতীয়তাবাদ জিনিসটা আসলে কী?
ঊনবিংশ শতকের প্রখ্যাত ফরাসি পণ্ডিত আর্নেস্ট রেনান এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও যথার্থ জবাব দিয়েছিলেন, ‘একটি জাতির সারাংশ হলো সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল থাকে এবং একই সঙ্গে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের বহু বিষয়ে অমিল থাকে।’
একটি জাতিকে যথার্থ ‘জাতি’ হয়ে উঠতে হলে তার নাগরিকদের অবধারিতভাবেই একটি বিষয় ভুলে যেতে হয়। সেটি কী? সেটি হলো জাতিগত ভিন্নতা। রেনান বলছেন, ‘কোনো ফরাসিই জানেন না তিনি বার্গান্ড নাকি আলায়িন, নাকি তাইফালা, নাকি ভিসিগোথ জাতি থেকে এসেছেন।’ প্রাচীনকালের জাতিগত ভিন্নতা ও বিভেদের পরিচয়কে অতীতেই রেখে আসতে হবে। রেনানের দাবি, প্রত্যেক ফরাসি নাগরিক ভুলে গেছেন যে ত্রয়োদশ শতকে পোপের বাহিনী খ্রিষ্টানদের প্রতিপক্ষ ক্যাথারস জাতিকে (দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইতালি ও ফ্রান্সের কিছু অংশে এই সম্প্রদায়ের বাস ছিল) প্রায় সমূলে বিনাশ করেছিল এবং ষোড়শ শতকে সেন্ট বার্থোলোমিউস ডেতে ক্যাথলিকদের উত্তেজিত জনতা হাজার হাজার ক্যালভিনিস্ট প্রটেস্ট্যান্টকে হত্যা করেছিল।
সুখের বিষয় হলো, রেনানের আমলে ফরাসিরা এ ধরনের পুরোনো শত্রুতা স্মরণাতীতকালের গর্ভে নিক্ষেপ করতে পেরেছিল এবং ফরাসিরা তা পেরেছিল বলেই তারা ‘ফরাসি’ হয়ে উঠতে পেরেছিল।
এখন কোনো জাতি যদি অতীতকে ভুলতে না পারে, তখন কী ঘটতে পারে?
এটি বুঝতে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার দিকে তাকানো যেতে পারে। বহু বছর ধরে মুসলিম বসনিয়াক, রোমান ক্যাথলিক ক্রোয়েট এবং পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স সার্বরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে মিলেমিশে ছিল। ১৯৮০-এর দশকের শেষে সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছিল, যুগোস্লাভিয়া টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। তখন সার্বদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল, যদি সত্যিই যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যায়, তাহলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির সংখ্যালঘু নাগরিকে পরিণত হবে। এই ভয় থেকেই তারা প্রতিবেশী মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালাতে শুরু করে। কূটকৌশলী চতুর স্লোবোদান মিলোসেভিচ সার্বদের মন বিষিয়ে তোলার জন্য প্রাচীন স্মৃতি অতিরঞ্জিত আকারে সবার সামনে আনলেন। ১৩৮৯ সালে কসোভোর ব্ল্যাকবার্ড ময়দানে তুর্কি মুসলিমদের হাতে সামন্ত রাজা লাজার হ্রেবেলজানোভিচের নেতৃত্বাধীন খ্রিষ্টান সার্ব সেনারা পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর প্রায় চার শ বছর কসোভোতে অটোমান সাম্রাজ্য শাসন করে। সেই যুদ্ধের ৬০০তম বার্ষিকী পালন করা উপলক্ষে মিলোসেভিচ সেই ব্ল্যাকবার্ড ময়দানে সার্বদের আহ্বান করে আনেন। হেলিকপ্টার থেকে তিনি ওই ময়দানে এমনভাবে নামেন যেন প্রিন্স লাজার আসমান থেকে আবার সার্বদের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে দেওয়া ভাষণে বললেন, ১৩৮৯ সালে সার্বদের সম্মান ছিল, এই ১৯৮৯ সালে সেখানে তাদের অপমান অসম্মান সহ্য করতে হচ্ছে, একসময় তাদের যে গৌরব ছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। তিনি উসকানিমূলক ভাষণ দিয়ে কয়েক শতাব্দী আগের মুসলমান-খ্রিষ্টান বৈরিতা ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে তুলে আনলেন। সেই বিষাক্ত অতীত সামনে এনে তিনি খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ বর্তমানকে ভেঙে খান খান করে ফেলেন। এরপরের কয়েক বছর তাঁর এই বক্তব্য ধরে গণহত্যার প্রচারণা চলতে থাকে। মিলোসেভিচের নেতৃত্বে শুধু স্রেব্রেনিকাতেই সার্বিয়ান যোদ্ধারা আট হাজার মুসলমানকে হত্যা করে।
হেনরি অ্যাডামস একবার রাজনীতিকে ‘ঘৃণা ছড়ানোর পদ্ধতিগত সংগঠন’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। যুগোস্লাভিয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই তাঁর এই কথা সঠিক। আমেরিকান রাজনীতিকেরাও যে এই দক্ষতা থেকে পিছিয়ে আছে, মোটেও তা নয়।
১৯৬৪ সালে মিসিসিপির নেশোবা কাউন্টিতে তিনজন অধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। যে জায়গাটিতে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮০ সালে নিজের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অঙ্গরাজ্যগুলোর অধিকারে বিশ্বাস করি’। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘আমি ঐতিহ্য রক্ষার অধিকারে বিশ্বাস করি’। উভয় নেতাই আসলে অতীতের গৃহযুদ্ধের ক্ষত উসকে দিয়ে বর্ণভিত্তিক শত্রুতাকে জাগিয়ে তুলেছেন।
জাতিত্বের মডেল আঁকতে গিয়ে রেনান জাতীয়তা পরিচয়ের নেতিবাচক সংজ্ঞাকে বাদ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। এর সঙ্গে তিনি আরও কিছু বিষয় যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, যথার্থ জাতি হয়ে উঠতে হলে ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাষা, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক বিবরণসম্পর্কিত রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি ভৌগোলিক সীমানার ধারণার ভিত্তিতে নাগরিকদের গোষ্ঠীবদ্ধতা পরিহার করতে হবে। নাগরিকদের একমত হওয়ার মতো বহু বিষয় আছে। একটি যথার্থ জাতি সেই বিষয়গুলোর অন্বেষণ করবে। বিশ্বমানবতার দুর্ভোগ-দুর্দশা, সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা—এসব বিষয়ে দলমত-নির্বিশেষে সবাই একটি সাধারণ ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে। এই আদর্শ মেনে কি নতুন কোনো জাতীয়তাবাদের সূচনা হতে পারে? হয়তো পারে। কিন্তু সেটি যে কত কঠিন, তা এডমুন্ড বার্ক ফাউন্ডেশন আয়োজিত ন্যাশনাল কনজারভেটিজম কনফারেন্সে দেখা গেছে।
ওই কনফারেন্সে বলা হয়েছে, ধর্ম এবং বর্ণগত পরিচয়ভিত্তিক গোষ্ঠীবদ্ধতার ভাবনা থেকে মানবজাতিকে আলাদা করা খুবই কঠিন। সম্মেলনে একজন বক্তা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট কাল ও স্থান থেকে ‘সংস্কৃতি’ ধারণাটি উদ্ভূত। ইংল্যান্ডের যাঁরা বাসিন্দা তাঁরা প্রধানত শ্বেতাঙ্গ এবং প্রটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক চার্চবিরোধী। তাঁদের এই ক্যাথলিক–বিরোধিতা একধরনের সংস্কৃতি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
আত্মপরিচয়ের গৌরব এখন নতুন জাতীয়তাবাদের জন্ম দিচ্ছে। এমন এমন বিশেষ পরিচয় আঁকড়ে মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চাচ্ছে, যার মাধ্যমে সে প্রতিপক্ষের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করছে। আমি ব্রিটিশ, ফরাসি নই; আমি আমেরিকান, মেক্সিকান নই; আমি খ্রিষ্টান, মুসলিম নই; আমি শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ নই—এ ধরনের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ভাবনা ধ্বংসাত্মক জাতীয়তাবাদের জন্ম দিচ্ছে।
আমাদের দেশ আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান, সেই চিন্তাকে সব সময়ই মহান চিন্তা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, স্বদেশ, স্বজাতি, স্বধর্মীদের উন্নতি ও অগ্রগতিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে এমন বিভাজক জাতীয়তাবাদের জন্ম হতে পারে, যা গোটা জাতিকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
লুইস হাইড: মার্কিন লেখক